ভারতে একটি বাঘিনীকে হত্যা করতে এত আয়োজন!

  12-10-2018 11:10AM


পিএনএস ডেস্ক ভারতের মহারাষ্ট্রের এক জঙ্গলে চলছে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান। বন বিভাগের কর্মকর্তা, বনরক্ষী, ট্রাংকুলাইজার বিশেষজ্ঞ, শার্প শ্যুটার, ট্র্যাকার, পশু চিকিৎসকসহ সব মিলিয়ে একশো জনের বেশি লোকের একটি দল। তারা সবাই মিলে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক বাঘিনীকে।

প্রায় ১৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বাঘিনী। সেখানে বন বিভাগ ১০০টি ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ধরা যায়নি তাকে। মনে হচ্ছে মানুষকে টেক্কা মারার মতো বুদ্ধি তার আছে।

স্থানীয় গ্রামবাসীরা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তারা চায় এই পশুটিকে হত্যা করা হোক। কিন্তু স্থানীয় বন বিভাগের প্রধান বলছেন, কাজটি সহজ নয়। ‘একদিকে পাহাড়, ঘন জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড়, যা কীনা বাঘের লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা, অন্যদিকে অনেক জায়গা পায়ে হেঁটে ছাড়া যাওয়াই যায় না। সেজন্যেই এই অভিযানে এত সময় লাগছে, বলছেন কে এম অপর্ণা।

ভারতীয় বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী যে কোন বন্য পশুকে আগে অজ্ঞান করে ধরার চেষ্টা করতে হবে। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে তাকে গুলি করে মারা যাবে।

ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১৪ সালের এপ্রিল হতে ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত এক হাজার ১৪৪ জন মানুষ বাঘ এবং হাতির কবলে পড়ে মারা গেছে।

এর মধ্যে হাতির কারণে মরেছে ১ হাজার ৫২ জন, আর বাঘের কাছে প্রাণ গেছে ৯২ জনের।

সিংহ, ভাল্লুক এবং অন্যান্য মাংসখেকো পশুর শিকার হয়েছে অনেকে। সাপ আর কুকুরের কামড়েও ভারতে শত শত মানুষ মারা যায়।

কিন্তু তারপরও বাঘের ভয়টাই ভারতে সবচেয়ে বেশি।

ভারতের শহুরে মানুষদের মধ্যে বাঘ সংরক্ষণের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। সে কারণে কর্তৃপক্ষ বাঘ রক্ষায় নানা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে।

‘যেসব মানুষ মরছে, তাদের অনেকেই কিন্তু বনের ভেতরেই মারা যাচ্ছে। আমরা মানুষ গিয়ে কিন্তু বাঘের সীমানায় ঢুকে পড়ছি’, বলছেন বন্য প্রাণী সংরক্ষণের পক্ষে সক্রিয় এক কর্মী অজয় দুবে। তিনি বন বিভাগের গুলি করে বন্য পশু মারার নীতির বিরুদ্ধে।

মহারাষ্ট্রের যে বাঘিনীকে হত্যার চেষ্টা করছে বন বিভাগ, সেটি নাকি এ পর্যন্ত ৫ জন মানুষকে হত্যা করেছে। ডিএনএ টেস্টে নাকি তার প্রমাণ মিলেছে।

‘সম্প্রতি এটি একজন লোককে ক্ষেতে কাজ করার সময় হত্যা করেছে। এরপর সেই লোকটির দেহ টেনে নিয়ে গেছে জঙ্গলের দিকে। যখন গ্রামের মানুষ বাঘিনীর দিকে পাথর ছুঁড়ে মারছিল , সেটিকে মোটেই ভয় পেতে দেখা যায়নি। এটি মোটেই স্বাভাবিক আচরণ নয়’, বলছেন বন বিভাগের কর্মকর্তা কে এম অপর্ণা।

বন বিভাগ এটিকে গুলি করে হত্যার যে নির্দেশ দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছিল পশুপ্রেমিকরা। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। তারপর বন বিভাগ আবার এটিকে হত্যার জন্য অভিযান শুরু করেছে।

সশস্ত্র বন রক্ষীরা যেহেতু গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে পারছে না, তাই তারা সেখানে যাচ্ছে হাতির পিঠে চড়ে।

হাতি নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার অনেক সুবিধা। প্রথমত এ ধরণের দুর্গম জঙ্গলে বাহন হিসেবে হাতি অনেক ভালো। আর দ্বিতীয়ত হাতির পিঠ থেকে শার্প শ্যুটারদের পক্ষে গুলি চালানোও অনেক সহজ। নিরাপদও বটে।

ভারতে বাঘের সংখ্যা বহু বছর ধরে কমার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার বাড়তে শুরু করেছে। এর কারণ বাঘ সংরক্ষণে নেয়া নানা পদক্ষেপ।

বিশ্বের ৬০ শতাংশ বাঘই থাকে ভারতে। ২০১৪ সালে এক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে মাত্র তিন বছরে ভারতে বাঘের সংখ্যা তিরিশ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৬টিতে।

কিন্তু অনেক বাঘই আসলে তাদের জন্য নির্দিষ্ট সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরেও থাকে। এই মানুষখেকো বাঘিনীটিও তাই। আর এজন্যেই মানুষের সঙ্গে বাঘের সংঘাত লেগেই থাকে।

যে দেশের জনসংখ্যা একশো তিরিশ কোটি, আর অর্থনীতি খুব দ্রুত বাড়ছে, সেদেশে মানুষের বিচরণ নেই এমন জায়গা আসলে খুব কমই আছে।

সাধারণত বৃদ্ধ বা আহত বাঘই মানুষখেকোতে পরিণত হয় বলে একটা কথা বলা হয়। কারণ বৃদ্ধ বয়সে এরা আর বন্যপ্রাণী শিকার করতে পারে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেক সময় একেবারে সমর্থ তরুণ বাঘও মানুষখেকোতে পরিণত হচ্ছে।

‘বেশিরভাগ বাঘ আসলে মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। প্রতি এক হাজার বাঘের মধ্যে হয়তো মাত্র একটি বাঘ মানুষখেকো। কিন্তু তারপরও আমরা তো ঝুঁকি নিতে পারি না এবং যেসব বাঘ মানুষখেকো বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সেগুলোকে নির্মূল করতেই হবে। একটা ভাগ ধরা কিন্তু সাংঘাতিক কঠিন কাজ,’বলছেন ভারতের সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ স্টাডিজের পরিচালক কে উলাস কারান্থ।

তবে বন্য পশু প্রেমীরা এখন মানুষখেকো বাঘদের রক্ষার জন্যও যেভাবে আন্দোলন শুরু করেছে তাতে মিস্টার কারান্থের মতো সংরক্ষণবাদীরাও বিস্মিত। তার মতে, প্রতিটি প্রাণীকে রক্ষার পরিবর্তে মনোযোগটা বরং দেয়া উচিত প্রজাতি রক্ষার দিকে।

ট্যাংকুলাইজার
ভারতের অনেক রাজ্যেই পশুদের খুঁজে বের করা বা তাদের ট্যাংকুলাইজার দিয়ে অজ্ঞান করার মতো দক্ষ মানুষ নেই। যে ট্র্যাংকুলাইজার ডার্ট বা বান মেরে বন্যপশুকে অজ্ঞান করা হয়, সেটি ব্যবহার করা খুব কঠিন। এটি ছুঁড়তেও হয় খুব কাছ থেকে।

‘এই যে ট্র্যাংকুলাইজার দিয়ে একটা প্রাণীকে অজ্ঞান করার এই তামাশা, তারপর সেটিকে আবার অন্য কোথাও ছেড়ে দেয়া, যেখানে সেটি কিনা আবার অন্য কিছু মানুষকে হত্যা করবে, এর কোন মানে হয় না’, বলছেন মিস্টা কারান্থ।

‘শহুরে লোকজন তাদের নিরাপদ ঘরে বসে বাঘের সৌন্দর্য নিয়ে অনেক বুলি কপচাতে পারেন, কিন্তু এ ধরণের মানুষখেকো বাঘের শিকার তো হচ্ছে গ্রামের মানুষ, তারাই তো পড়ছে ঝুঁকিতে।’

কিন্তু ভারতে পশু প্রেমীরা দমে যাওয়ার পাত্র নয়। চেঞ্জ ডট ওর্গ সাইটে এক আবেদনে ৪৫ হাজার মানুষ এরই মধ্যে সই করেছে। তারা দাবি জানাচ্ছে এই মানুষখেকো বাঘিনীকে না মেরে জীবিত ধরা হোক। অজয় দুবে বলছেন, তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন।

আপনি যদি এই বাঘিনীকে হত্যা করেন, তার দুই শিশু শাবকও কিন্তু মারা যাবে। মাত্র তিন হাজার বাঘের মধ্য থেকে তিনটির মৃত্যু কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি। আমাদের উচিত বরং জঙ্গলের ভেতর মানুষের বেআইনি প্রবেশ বন্ধ করা।

তবে কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বাঘিনীটিকে ধরার কাজটাকেই আগে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তারা একই সঙ্গে তার শাবক দুটিকেও ধরার চেষ্টা করবেন, তাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাবেন।

তবে ভারতে বাঘ হত্যার পক্ষে-বিপক্ষে এই বিতর্কের মাঝে স্থানীয় মানুষ আছেন আতংকে। শীঘ্রই তাদের এই আতংকের অবসান ঘটবে, সেটাই তারা আশা করেন।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন