নায়ক থেকে খলনায়ক সু চি

  10-12-2019 01:52PM


পিএনএস ডেস্ক: একসময় তাকে সর্বজনীন মানবাধিকারের আলোকবর্তিকা রূপে দেখা গিয়েছিল। তিনি এমন একজন যিনি কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক শাসক জেনারেলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের স্বাধীনতা ত্যাগ করেছিলেন।

১৯৯১ সালে "দ্য লেডি" খ্যাত সেই অং সান সু চিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান তাকে "শক্তিহীনদের শক্তির অসামান্য উদাহরণ" বলে অভিহিত করেছিলেন।

তবে মিয়ানমারে ২০১৬ সাথে গণতন্ত্রের পথ সুগম হওয়ার পর তিনি কার্যত দেশটির শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে তোলে নেন। এসময় আন্তর্জাতিক নেতাকর্মীরা তাকে সমর্থন করেছিলেন।

পরবর্তীতে ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর সাথে আরকান অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানদের দ্বন্দ্বে মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে জীবন নিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়। এসশয় সু চির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তিনি সামরিক অভিযানের নিন্দা বা নৃশংসতার অভিযোগ অস্বীকার করে ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যা বন্ধে কিছুই করেনি।

বহিঃর্বিশ্বের যারা সু চির সমর্থক তারা বলেছেন, সু চি বহু-জাতিক একটি দেশ পরিচালনা করছেন, যেখানে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল না বলেলেই চলে।

তারা আরও উল্লেখ করেছেন, সেনাবাহিনী এখনও বেশিরভাগ রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রেখেছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণও তারা ছেড়ে দেয়নি।

তবে সমালোচকরা বলছেন যে তিনি নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন এবং ব্যক্তিগত ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও মানবাধিকারের পক্ষে তার দাঁড়ানো উচিত ছিল।

তৎকালীন সামরিক শাসিত মিয়ানমারে (বার্মা) গণতন্ত্র আনার প্রচেষ্টার কারণে ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সু চি তার বেশিরভাগ সময় তাকে বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছেন। এটা সত্য যে এই বন্দীত্ব তাকে আন্তর্জাতিকভাবে শান্তি প্রতীক করে তুলেছে। তিনি নিপীড়নের মুখে প্রতিরোধক হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন।

তিনি ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যা ২০১৫ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের প্রথম প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৫ বছরের গৃহবন্দি থেকে মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর পরে এই বিজয় এসেছিল।

সু চির প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না; তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন যা কিনা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান।

আধুনিক মায়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চির কন্যা সু চির জন্ম হয় ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক অর্জন করার পর তিনি জাতিসংঘে তিন বছর কাজ করেন।

১৯৭২ সালে মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। ১৯৮৮-র গণআন্দোলনের সময় সু চি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন।

সেসময় সদ্যগঠিত দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামরিক জান্তার বিরোধী অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে এনএলডি সংসদের ৮১ শতাংশ আসন পেলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হৈ চৈ ফেলে দেয়।

এদিকে নির্বাচনের আগে থেকেই সু চিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই তাকে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়; ততদিনে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রখ্যাত রাজবন্দীদের একজন হয়ে উঠেছেন।

একসময় যারা সু চিকে বন্দী জীবনে পাঠিয়েছিলেন আজ তাদের রক্ষা করতেই তিনি বিদেশে দৌড় ঝাঁপ শুরু করেছেন।

রোহিঙ্গা মুসলিম ও শরণার্থীদের সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া
কিছু অ্যাকটিভিস্ট ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে অং সান সু চির নীরবতার সমালোচনা করেন। (২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে), এবং মায়ানমারের নিপীড়িত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের পলায়নও সু চি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেন।
২০১২ সালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক বলে ভাবা যাবে কি না তা তিনি জানেন না। ২০১৩ সালে বিবিসির মিশাল হুসাইনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে সু চি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করেননি এবং মায়ানমারে মুসলিমদের জাতিগত নির্মূল হতে থাকার কথা অস্বীকার করেন, বরং জোর দিয়ে বলেন যে "বৈশ্বিক মুসলিম শক্তি অনেক গ্রেট - এই বিশ্বব্যাপী কল্পিত ধারণা"র কারণে সৃষ্ট "আতঙ্কের আবহে"ই সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

পিটার পপহ্যামের মতে, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মুসলমান ছিলেন বলে সাক্ষাৎকারের পরে সু চি রাগ প্রকাশ করেন। সু চি দাবি করেছিলেন যে দুপক্ষেই সহিংসতা হচ্ছে, তখন হুসাইন তাকে চ্যালেঞ্জ করেন যে সহিংসতার প্রায় সব প্রভাব কেন শুধু রোহিঙ্গাদের ওপরই পড়ছে। পিটার পপহ্যাম সু চির এরূপ অবস্থানকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দ্ব্যর্থবোধক অবস্থান বলে মন্তব্য করেন।

২০১৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সাথে আলাপকালে তিনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হিসেবে অভিহিত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে যা ২০১৯ সালে ডেভিড ক্যামেরনের ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি নিয়ে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন।

সু চি বলেন, তিনি সমঝোতার জন্য কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু তিনি কোনো পক্ষে যাবেন না, কারণ দুপক্ষই সহিংসতায় জড়িত।

দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার মতানুসারে, তিনি "রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের পক্ষে তিনি স্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার জ্যোতির্ময় মহিমা বিদেশি মানবাধিকার কর্মীদের সামনে পদস্খলিত হয়েছে।"

২০১৫ সালে একটি বিবিসি নিউজ আর্টিকেলে রিপোর্টার জোনাহ ফিশার মনে করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সু চির নীরবতা আসলে আসন্ন ২০১৫ সালের জতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগুরু বামারদের সমর্থন পাবার আশায়।

২০১৫ সালের মে মাসে চতুর্দশ দালাই লামা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য সু চির প্রতি আহ্বান জানান এবং দাবি করেন, তিনি এর আগে দুবার ব্যক্তিগত সাক্ষাতে সু চিকে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ভাবার জন্য বললেও সু চি তা কানে তোলেননি।

২০১৬ সারের মে মাসে সু চি মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েলকে বলেন, রোহিঙ্গাদের "রোহিঙ্গা" নামে উল্লেখ করা যাবে না, তারা 'মুসলিম সংখ্যালঘু'। বার্মারা তখন "রোহিঙ্গা" শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে।

২০১৬-১৭ সালের নির্যাতনের সময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ষা করতে ব্যর্থতা হওয়ায় সু চি অভিযুক্ত হন। লন্ডনের কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট ক্রাইম এক্সপার্টরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন, সু চি মায়ানমারের "গণহত্যাকে আইনসম্মত" হিসেবে দেখাচ্ছেন।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চলতে থাকলেও, "সেনাবাহিনীর প্রমাণিত ধর্ষণ, খুন ও রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংসের অভিযান বন্ধ করা তো দূরের কথা, সু চি সেসব স্বীকারই করছেন না।"

৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মায়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি রাখাইনের "বাস্তবিকই মারাত্মক" পরিস্থিতি নিয়ে সু চির প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, "আইনের আওতায় সবাইকে সুরক্ষা দিতে এই ডি ফ্যাক্টো নেত্রীর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন - যেটা আমরা যেকোনো সরকারের কাছেই আশা করি।"

বিবিসি রিপোর্ট করেছে, "তার মন্তব্য এমন সময়ে এলো যখন বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা জাতিসংঘের হিসাবে ৮৭ হাজারে পৌঁছেছে।"

এছাড়াও, শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেছিলেন, তিনি মিস সু চির মুখ খোলার অপেক্ষায় আছেন যিনি কিনা এই সংকট সৃস্টির পর কোনো মন্তব্য করেননি।"

পরদিন জর্জ মনবিও দ্যা গার্ডিয়ানে তার লেখায় সু চির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চেঞ্জ ডট অর্গে একটি পিটিশনে সই করতে পাঠকদেরকে আহবান জানান ও বলেন, "পক্ষপাতিত্বই হোক বা ভয়েই হোক, সু চি অন্যদের স্বাধীনতার অধিকার অস্বীকার করছেন, যে স্বাধীনতা তিনি একসময় নিজের জন্যে চেয়েছিলেন। তার সরকার বাধা দিচ্ছে এবং কখনো বা নীরব থাকছে সেই অ্যাকটিভিস্টদের ব্যাপারে যারা তার নিজের অধিকার আদায় করতে সাহায্য করেছিলেন।

শান্তিতে আরেক নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুও সু চির নীরবতার সমালোচনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে তিনি বলেন, "হে আমার বোন, মায়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোই যদি তোমার নীরবতার কারণ হয়ে থাকে, তার জন্য সত্যিই বড় বেশি দাম দিতে হচ্ছে ... ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হয়ে ওঠা একজনের জন্য এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দেওয়া বেমানান।"

ঐ বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর জানা যায়, পরের সপ্তাহে এই মানবিক সংকট নিয়ে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অং সান সু চি অংশ নেবেন না। মায়ানমার সরকারের এক মুখপাত্র বলেন "হতে পারে তার আরো জরুরি কোনো কাজ আছে।"

যাই সেই তথাকথিত গণতন্ত্রের নেত্রী সু চি এখন নেদারল্যান্ডের হেগ-এর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)। রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে জাতিগত নিধনের দায়ে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিতে প্রথম দেশ হিসেবে এগিয়ে আসে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। তারা মিয়ানমারকে দায়ী করে মামলা করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)।

মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আদালতে এ মামলার শুনানি শুরু হবে। চলবে আগামী ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। উইকিপিডিয়া ও বিবিসি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন