ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছেন সু চি?

  27-01-2020 11:50AM


পিএনএস ডেস্ক: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের বিপরীতে নিজের অস্পষ্ট অবস্থানের কারণে বহু আগেই নিজের অর্জিত সম্মান হারিয়েছেন একসময়কার এশিয়ার ম্যান্ডেলা অং সান সু চি। এখনকার রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি সবশেষ গত বছর ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিজ দেশের সেনাবাহিনীর গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে হাজির হয়ে নিজের কষ্টার্জিত আন্তর্জাতিক সম্মানের অবশেষটুকুও নষ্ট করেছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইসিজে মিয়ানমারকে গণহত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পর সু চি এখন কেবলই একজন ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরাচার, যিনি ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষে দাঁড়ান।

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকাণ্ড, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে গত ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া। গত বছর ডিসেম্বরে ওই মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষে সাফাই গান সু চি। বিশ্বপরিসরে সু চি মানবাধিকার হরণের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়েছিলেন যতটা না আদালতে লড়াই করার জন্য, তার থেকে বেশি নিজ দেশে তার জাতীয়তাবাদী গ্রহণযোগ্যতাকে ঝালিয়ে নিতে।

নিজ দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন সু চি। তাতে অবশ্য আদালত প্ররোচিত হননি। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছেন আইসিজে। সাবেক মার্কিন কংগ্রেস সদস্য এবং জাতিসঙ্ঘ দূত বিল রিচার্ডসন বলেন, আইসিজের অন্তর্র্বর্তী আদেশের পর সু চি তার সমস্ত মান-সম্মান খুইয়েছেন। গণতন্ত্রের জন্য নোবেলজয়ী থেকে তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন একজন স্বৈরশাসকে, যে তার ক্ষমতা ধরে রাখতে সামরিক নিপীড়ন, গণহত্যা ও রোহিঙ্গা নিধনকে বৈধতা দেন।’

জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় গণহত্যার আলামত পেলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সু চিও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নিতে সক্ষম হননি। বরং গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতেও কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি, উল্টো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে থাকার দায় ঢাকার ওপর চাপিয়েছেন। সবমিলে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষায় তার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামরিক শাসনের মিয়ানমারে সু চির অহিংস আন্দোলন চূড়ান্ত সাফল্য পায় ২০১৫ সালে। ওই বছর তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায়। আশা করা হচ্ছিল এর মাধ্যমে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। তবে বিপরীত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ক্রমশ পতনের পথে ধাবিত হতে থাকেন সু চি। পতনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর।

রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর সামনে আসতে শুরু করলে ১৯৮৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু এক খোলা চিঠিতে সু চিকে লিখেছিলেন, “জনজীবনে আপনার উত্থান হওয়ার পর রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে আমাদের উদ্বেগ প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু এখনো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বজায় রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ, আবার অনেকের কাছে তা ‘ধীর গতির গণহত্যা’। সম্প্রতি সেই সহিংসতা আরো বেড়েছে। ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে কোনো ব্যক্তি দেশ পরিচালনা করতে গেলে এ বিষয়গুলো তার কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ার কথা। এমন যদি হয় যে আপনার নীরবতা হলো মিয়ানমারের উচ্চ পদে আসীন হওয়ার রাজনৈতিক মূল্য চুকানো, তবে নিশ্চিতভাবে বলব এ মূল্যটা খুব চড়া।”

জাতিসঙ্ঘ দূত বিল রিচার্ডসন বহুদিন সু চির প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। রাখাইন সঙ্কট নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হতে পাঠানো সু চির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিক রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর প্রকাশের জেরে গ্রেফতার হলে তাদের মুক্তি দিতে সু চির প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে সেই পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান সু চি। মোহমুক্তি ঘটে রিচার্ডসনের। উপদেষ্টা বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। রিচার্ডসন সেই প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছিলাম একজন সংস্কারক ও সাবেক গণতন্ত্রপন্থী কিভাবে ক্ষমতাপ্রিয় ও সুরক্ষিত নেতায় পরিণত হচ্ছেন। -এপির বিশ্লেষণ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন