করোনা নিয়ে ভয়ের কারণ নেই কেন, জানালেন ভারতীয় চিকিৎসক

  01-04-2020 07:16PM

পিএনএস ডেস্ক : সারা বিশ্বে ভীতি ছড়ানো করোনাভাইরাস নিয়ে অভয় দিলেন ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজির (এআইজি) চেয়ারম্যান ও পদ্মভূষণপ্রাপ্ত জি পি নাগেশ্বর রেড্ডি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিকিৎসক বলেছেন, এ ভাইরাসকে জয় করা সম্ভব। আর ভারতে দেওয়া তিন সপ্তাহের দেশব্যাপী লকডাউন আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন তিনি। ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পত্রিকাটির সম্পাদক জি এস ভাসু। ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জীবনরহস্যের উন্মোচন এবং এর ওপর তাপমাত্রার প্রভাবের দুটো বিষয়ে তুলে ধরে আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি। এ সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরা হলো

ভাসু: ভাইরাসের উৎস ও বিস্তার নিয়ে আপনি গবেষণা করেছেন। আপনার কি মনে হয় এটা ভারতের জন্য ঝুঁকির কারণ?

রেড্ডি: এর ইতিহাস যদি দেখেন, তবে এটি গত বছরের মধ্য ডিসেম্বরে চীনের উহানের সামুদ্রিক প্রাণীর একটি বাজারে এর উৎপত্তি হয়েছে। এরপর এটি ছড়িয়েছে। উহান থেকে এটি পশ্চিমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ছড়িয়েছে। ছড়ানোর দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে পরোক্ষভাবে এটি ভারতে এসেছে। তাই একে বুঝতে তিন থেকে চার সপ্তাহের একটা ফাঁক রয়ে গেছে। করোনাভাইরাস আরএনএ ভাইরাস। এ সুনির্দিষ্ট ভাইরাসটির সঙ্গে বাদুড়ের সম্পর্ক আছে। যদিও আমরা এখনো জানি না, এটি বাদুড় থেকে এসেছে কি না। তবে বাদুড় থেকে মানুষে ছড়াতে এর একটি ছোট পরিবর্তন ঘটেছে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই ভাইরাস যখন ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে ছড়িয়েছে, তখন এর জিনগত কিছু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়েছে। চারটি দেশ—প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, পরে ইতালি, এরপর চীন এবং চতুর্থত, ভারতে এর জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ইতালিতে ছড়ানো ভাইরাসের সঙ্গে ভারতে ছড়ানো ভাইরাসের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর গুরুত্ব অত্যধিক হতে পারে। কারণ, ভারতের ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে কিছু কিছু জিনগত পরিবর্তন হয়েছে। স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমেই ভাইরাসটি মানবশরীরের কোষে সংযুক্ত হয়। ভারতের ক্ষেত্রে কম যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ, এটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।


কিন্তু ইতালিতে এ ভাইরাসের আরএনএতে তিনটি নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন হয়েছে। আর এর ফলে এটি মানুষের জন্য আরও মারাত্মক হয়ে পড়েছে। ইতালিতে অন্য কিছু বিষয় কাজ করেছে। সেখানে মারা যাওয়া বেশির ভাগ মানুষের বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস একটি বিষয়। এর পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপেরও আধিক্য আছে। এসব মিলিয়ে সেখানে মৃত্যুর হার সাধারণের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে এ হার ২ শতাংশ।

Lifebuoy Soap
ভাসু: তাহলে আপনার মতে, ভারতে ছড়ানো ভাইরাসটি অন্য দেশে ছড়ানো ভাইরাসের তুলনায় কম ক্ষতিকর। আমরা এটা বলতে পারি?

রেড্ডি: না, আমরা সরাসরি এটা বলতে পারি না। তবে এটা বলতে পারি, এ ভাইরাসের অবশ্যই ভিন্নতা আছে। আর আমরা আশা করছি, এটি কম ক্ষতিকর হবে। কারণ, কোষের সঙ্গে এর সংযুক্তি খুব জোরালোভাবে হয়নি। কিন্তু বড় ধরনের কোনো গবেষণার আগে এটা আমরা বলতে পারি না যে এটা শতভাগ সত্যি।

ভাসু: এখন ভারতজুড়ে যে লকডাউন করা হয়েছে, এটা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। অনেকে মনে করেন, শুধু চিহ্নিত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এটা দেওয়া যেত, আবার কেউ মনে করেন, পুরোপুরি লকডাউনই আসল সমাধান। আপনার মত কী?

রেড্ডি: এটা একটা বিতর্কিত বিষয়। দুটো পুরোপুরি চরমপন্থা আছে। একটি হলো, পুরোপুরি লকডাউন। আরেকটি হলো, সবকিছু খোলা রেখে সবাইকে টেস্ট করানো। যেটা দক্ষিণ কোরিয়া করেছে। সেখানে সবকিছু খোলা আছে, কিন্তু তারা ব্যাপকভাবে টেস্ট করেছে। টেস্টে যাদের পজিটিভ পাওয়া গেছে, তাদের আলাদা করে ফেলা হয়েছে। এর অর্থ হলো রেড জোন বা সিলেকটিভ জোন। কিন্তু আমাদের দেশে (ভারত) জনসংখ্যার কারণে ব্যাপক হারে টেস্ট করার বিষয়টি যৌক্তিক না। সে ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র বিকল্প হলো পুরোপুরি লকডাউন। যেটা এখানে করা হয়েছে।

এর একটা আর্থিক মূল্য দিতে হবে। তবে আমার মনে হয়, সাময়িক বা দু–তিন সপ্তাহের জন্য লকডাউন আমাদের জন্য খুবই দরকার ছিল। কিন্তু এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রশ্ন উঠবে, এরপর কী? সেখানে আমার মনে হয়, একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিতে হবে। এর মধ্যে আমরা টেস্ট শুরু করেছি। আর এ কিটের দামও সস্তা হয়ে যাবে। এরপর আমরা নির্দিষ্ট স্তরে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারব।

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জনগোষ্ঠীর এক নির্দিষ্ট অংশ, যাঁদের বয়স বেশি এবং যাঁদের শারীরিক অন্য সমস্যা আছে, তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এসব মানুষকে বেশি করে টেস্ট করতে হবে এবং তাঁদের আলাদা রাখতে হবে। অপেক্ষাকৃত কম বয়স যাদের এবং যাদের অন্য সমস্যা নেই, তাদের মুক্তভাবে চলতে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সবই করা উচিত এই লকডাউন শেষ হয়ে যাওয়ার পর। আমার মনে হয়ে, করোনা নিয়ে যে ভীতি ছড়িয়েছিল এর পরিপ্রেক্ষিতে লকডাউন খুবই দরকার ছিল। কিন্তু দীর্ঘ লকডাউন বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। এটি তিন সপ্তাহের বেশি হওয়া উচিত নয়।

ভাসু: ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকে নানা মত শোনা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেউ বলছেন, উষ্ণ আবহাওয়ায় এটি বাঁচবে না। কেউ বলছেন, ষাটের বেশি যাঁদের বয়স, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। ভয় আছে, শঙ্কা আছে—কোনোটি হয়তো ঠিক, কোনোটি নয়। আপনার কী মত?

রেড্ডি: এ ভাইরাসকে ঘিরে নানা কাহিনি আর মিথ্যা সংবাদ তৈরি হয়েছে। প্রথম কথা হলো, আমাদের ভীত হওয়া যাবে না একেবারেই। এমন কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়নি যে আমাদের ভীত হতে হবে। আমাদের এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে ইতালি ও ফ্রান্সে যা হয়েছে, এখানে তা হবে। দ্বিতীয় কথা হলো, এই ভাইরাস ১০ বছরের কম বয়সীদের আক্রান্ত করে না। দু-একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। তবে এর সংখ্যা খুব বেশি নয়।

এখন আসি বয়স্কদের বেলায়। এখানে জৈবিক বয়সের চেয়ে শারীরিক বয়সটি বেশি তাৎপর্য বহন করে। সাধারণভাবে যাঁদের বয়স সত্তেরর বেশি এবং যাঁদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বা ক্যানসার আছে, তাঁদের এই ভাইরাস মারাত্মকভাবে ঘায়েল করতে পারে। কিন্তু এমন শারীরিক সমস্যা না থাকলে ৬০-৬৫ বছর বয়সীদেরও ভয়ের কারণ নেই। শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান যে কারও জন্য এই ভাইরাস বড় কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। দেখুন, ভারতে এখনো এমনকি বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর হার ইতালির মতো না। তাই আমার কথা, ভয় দূর করতে হবে।

যে বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে না, তা হলো মানসিক স্বাস্থ্য। এই ভীতির কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ, যারা মানসিকভাবে শক্ত ও সুখী, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। আমরা হতাশ হয়ে গেলে ভালো থাকব না।

মানুষের কাছে ইতিবাচক বার্তা যাওয়া উচিত। ভয় পাবেন না। এই লকডাউন অত্যাবশ্যক ছিল। এখন ঘরে নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করুন।

আসি তাপমাত্রার বিষয়ে। এটা নিয়ে এখনো বিস্তর বিতর্ক আছে। কিন্তু এমআইটির যে গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে এই ভাইরাসের তাপ-সহনশীলতার বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৩২ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে এটি দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারবে না।

এখানে ভারতের ক্ষেত্রে বলা যায়, মে মাসে যখন তাপ আরও বাড়বে, তখন ভাইরাসের সংক্রমণের হার কমে যেতে পারে। তাপমাত্রার একটা ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু তা হবে মে মাসের পর।

ভাসু: এসব গবেষণা কী শেষ হয়েছে?

রেড্ডি: এমআইটির গবেষণাটি পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেটা উপকারী হতে পারে। কিন্তু আমি বলছি, এটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। ক্লিনিক্যালি এটা প্রমাণিত হয়নি।

ভাসু: একটা ভয় আছে যে এ ভাইরাস আবার ফিরে আসতে পারে?

রেড্ডি: এর আগে যতগুলো করোনাভাইরাস দেখা গেছে, সবগুলোর মধ্যেই ঋতুভিত্তিক একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। সার্স, মার্স, সোয়াইন ফ্লু—সবকিছুতেই ঋতুর একটি প্রভাব ছিল। কিন্তু এর পর একটা আশা আছে যে আমরা হয়তো একটা ভ্যাকসিন পেয়ে যাব। তাই আগামী বছর এ সময় আমরা হয়তো একটা রক্ষাকবচ পাব। কিন্তু আগামী ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। তবে সে সময় কোনো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকলেও টেস্টটি অনেক কমে যাবে এবং এটি সহজ হবে বলে আশা করা যায়।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন