তাদের চোখে তখন অশ্রু ছলছল

  26-08-2016 07:06AM


পিএনএস: এক নাটকীয় মুহূর্ত। ভূমিকম্পের পর ইতালির চারদিকে এখন ধ্বংসস্তূপ। সবাই আস্তে আস্তে তার ভেতর থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এমন সময় ১৮ ঘণ্টা পর সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১০ বছর বয়সী একটি মেয়েকে। তার নাম জুলিয়া। তাকে নিয়ে শোকে পাথর মানুষের মধ্যে অন্য রকম এক আনন্দের ঢেউ। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। উদ্ধার করা জুলিয়াকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন উদ্ধারকর্মী। তা দেখে আশেপাশে দাঁড়ানো অন্য উদ্ধারকর্মীরা হাততালি দিচ্ছেন। দূরে দাঁড়ানো উদ্বেগাকুল মানুষের যেন তর সইছে না। তাদের বেশির ভাগের চোখে তখন অশ্রু ছলছল। এমন দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে ইতালির ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকায়। সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে কোনো অকস্মাৎ ক্ষীণ কণ্ঠ শুনতে পান একজন উদ্ধারকর্মী। তিনি অন্যদের জানান তা। বলেন, এখানে এই ধ্বংসস্তূপের ভেতর তোমরা কি কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছ। শান্ত হয়ে শোনার চেষ্টা করো। বলতে বলতে তিনি দু’হাতে সরাচ্ছিলেন আবর্জনা। মাথার ওপরে তখন বিশাল এক লোহার বিম। ধ্বংসস্তূপে ছেয়ে আছে স্থানটি। তিনি আবর্জনা সরাতে সরাতে দেখতে পান দুটি পা। শুধুই দুটি পা দেখা যাচ্ছে। এটা কোনো শিশুর পা তিনি নিশ্চিত হয়ে যান। খুব সতর্কতার সঙ্গে তিন/চারজন উদ্ধারকর্মী শুরু করেন উদ্ধার অভিযান। তারা আস্তে আস্তে আবর্জনা সরিয়ে ফেলেন। তারা শিশুটিকে আহ্বান জানান, জুলিয়া এসো। এখন তুমি নিরাপদ। বেরিয়ে এসো। তারা জীবিত তুলে আনেন ওই বালিকাকে। একজন উদ্ধারকর্মী তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ছুটে যান জরুরি সেবা দেয়ার জন্য। এ সময় হাসি-আনন্দ-কান্নার এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেখানে। এমন দৃশ্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে, বিভিন্ন মিডিয়ায়।
ইতালিতে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ২৪১

২ শিশুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সবাই
ধ্বংসস্তূপের ভেতর শুধু লাশ আর লাশ। উদ্ধারকারীরা গত রাতে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে আনেন ৮ মাস ও ৯ বছর বয়সী দুটি শিশুর লাশ। পিতামাতার সঙ্গে তারাও ভবন চাপাপড়ে নিহত হয়েছে। তাদের লাশ দেখে সেখানে উপস্থিত লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই কান্না যেন পুরো ইতালিকে গ্রাস করেছে। চারদিকে শোক। যারা বেঁচে আছেন তাদের বাঁচার আকুতি। এ এক অন্যরকম ইতালি। ভূমিকম্পের আঘাতে লণ্ডভণ্ড সব। স্বজন হারানো মানুষের মাতম আর আহতদের আর্তনাদে সেখানকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ২৪১। এখনও অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। আহত অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। ফলে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চারদিকে শুধুই ধ্বংসাবশেষ। এ অবস্থায় সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার জরুরিভিত্তিতে আক্রান্তদের কীভাবে সহায়তা দেয়া যায় তা নির্ধারণে মন্ত্রিপরিষদের সভা আহ্বান করেছেন প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি। তিনি বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এ দিনটি হলো কান্নার। আগামী দিনগুলো হলো পুনর্গঠনের। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, গত রাতভর উদ্ধারকর্মীরা জীবিতদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। মঙ্গলবার দিবাগত রাতের শেষভাগে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প বিরানভূমি করে দিয়েছে ইতালির মধ্যাঞ্চল। আমাট্রিস শহরে হোটেল রোমা ধসে পড়েছে। এতে ছিলেন ৭০ জন অতিথি। সেখান থেকে মাত্র ৭টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিদের এখনও কোনো হদিস মেলেনি। এ শহরের মেয়র বলেছেন, এবারের ভূমিকম্পে এ শহরটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে লোকালয়। রাস্তাগুলোতে মারাত্মক সব ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। এটি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ভূমিধসের সমূহ আশঙ্কা করা হচ্ছে। যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থা সঙ্গীন। হাজার হাজার মানুষ অবস্থান করছেন তাঁবুতে। তাতে আশ্রয় নেয়া আলেসান্দ্রো গাব্রিয়েলি বলেছেন, রাতগুলো হবে আমাদের কাছে সবচেয়ে ভীতিকর। প্রতিটি তাঁবুতে অবস্থান করছেন ১২ জন করে মানুষ। এমন তাঁবু পাতা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে, পার্কিং এলাকায়। আলেসান্দ্রো বলেন, মঙ্গলবার রাতে আমাদের ঘুম ভেঙেছে বিকট শব্দে। মনে হচ্ছিল বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে কোথাও। ওদিকে উদ্ধারকর্মীরা অন্ধাকারের ভিতরেই ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার করেছেন ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে শিশুকে। পেসকারা ডেল ট্রোনটো’তে একটি ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রায় ১৭ ঘণ্টা ধরে আটকা পড়েছিল শিশুটি। পরে উদ্ধার করা হয়েছে তাকে। কিন্তু তার মতো সৌভাগ্যবান নয় অন্য অনেক শিশু। আকুমোলি শহরের পাশে একটি গ্রামে চার সদস্যের একটি পরিবার চাপা পড়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। এর মধ্যে রয়েছে ৮ মাস ও ৯ বছর বয়সী দুটি শিশু। উদ্ধারকর্মীরা যখন এই শিশু দুটির মৃতদেহ কম্বলে জড়িয়ে বের করে আনেন তখন তাদের দাদি কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী করে তোলেন। তিনি চিৎকার করে বলেন, ঈশ্বর কেন সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে নিলো?
ইতালির এ ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ল্যাজিও ও মারচে অঞ্চলে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ল্যাজিওতে। ভূমিকম্পে পাশ্ববর্তী আমব্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ তিনটি অঞ্চলেই দীর্ঘদিন ধরে কয়েক শতাব্দীর পুরনো ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে এগুলো ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ। ইতালির বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে বৃহস্পতিবার সকালে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ২৪৭ জন বলে জানানো হয়েছিল। পরে তা সংশোধন করে ২৪১ জন করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এদিকে মঙ্গলবার গভীর রাতে আঘাত করা ভূমিকম্পের পর শতাধিক আফটারশক অনুভূত হয়েছে। বৃহস্পতিবারও এমন বেশকিছু আফটারশক আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে দুইটি ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৫.১ ও ৫.৪। এতে একদিকে উদ্ধারকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আকাশ ঢেকে গেছে প্রচুর পরিমাণ ধুলায়। প্রবল ভূকম্পনের পর এসব আফটারশক আক্রান্ত মানুষদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁবুতে অবস্থান করা আরকুয়াটা ডেল ট্রনটো গ্রামের ৭০ বছর বয়সী আর্তুরো ওনেসি বলেন, ‘এতই ভয় পেয়েছি যে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।’

ভূমিকম্পে আহত প্রায় ২৭০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর উদ্ধারকাজে পুলিশ, অগ্নিনির্বাপককর্মী, সেনা সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবীসহ প্রায় ৫ হাজার ব্যক্তি নিয়োজিত রয়েছেন। উদ্ধারকর্মীরা সাংবাদিকদেরও আক্রান্ত এলাকা আমাট্রিস থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন, শহরটি ধ্বসে পড়ছে। আমাট্রিস ছাড়াও অন্যান্য এলাকাগুলোতেও ভূমিকম্পে আঘাতপ্রাপ্ত অনেক ভবন এখনও ধ্বসে পড়ছে।
কেন প্রায়ই ভূমিকম্প হয়?

ইতালির ভূকম্পনের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। কিন্তু এতে বড় ধরনের প্রাণহানি বা হতাহতের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বিরল। দু’টি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত এ দেশটি। অর্থাৎ, এটি এমন অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে ভূখণ্ডের নিচে উল্লেখযোগ্য মাত্রার কম্পন ও অগ্ন্যুৎপাত-সংক্রান্ত ক্রিয়া ঘটে থাকে।

বৃটেনের স্কাই নিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ ও মধ্য আপেনাইনস পর্বতমালায় যদি ভূমিকম্প আঘাত হানতো তাহলে ফল হতো আরো বিপর্যয়কর। আপেনাইনস পর্বতমালার এ দু’অংশকে বলা হয় ইতালির মেরুদণ্ড। মধ্য ইতালিতে বুধবারের ভূমিকম্পের আগে, সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় বিপর্যয়কর ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৯ সালের ৬ই এপ্রিল। সেদিন রোমের পূর্বে আবরুজ্জো অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল ভূমিকম্প। তাতে প্রাণ হারায় ৩ শতাধিক মানুষ। বিধ্বস্ত হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠা লা’কুলা শহর।
এরপর ২০১২ সালে ভূমিকম্পে ধ্বংস হয় উত্তর ইতালির মোডেনা শহরের বহু ভবন। চার বছর আগের ওই বিপর্যয়ে প্রাণ হারান ১৬ জন। আহত হন ৩৫০ জন। এর ঠিক ৯ দিন আগে আরেকটি ভূমিকম্পে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন।
১৯১৫ সালে ইতালিতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয়। মধ্য ইতালির আভেজ্জানো শহরে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় প্রায় ৩২,৬০০ মানুষ। ১৯৮০ সালে নিহত হয় প্রায় ৩ হাজার মানুষ। আহত হয়েছিল সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। ওই ভূকম্পনের কেন্দ্রস্থল ছিল ইবোলি শহর। নেপলসের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ক্ষয়ক্ষতির কথাও জানা যায়।

ইউরোপের সবচেয়ে বেশি ভূকম্পন ঘটে যে ক’টি দেশে, তার মধ্যে ইতালি একটি। উত্তরে আল্পস পর্বতমালা হলো ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে আফ্রিকান টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কার ফল। এ প্রক্রিয়াটি এখনও চলছে। প্রতি বছর ৩ সেন্টিমিটার করে নড়ছে দু’টি প্লেট। ইতালির শিরদাঁড়ায় প্রায় পুরোটা সময় উত্তরের খাঁড়ি বা ভূ-ত্বকে দুর্বলতা বা স্তরচ্যুতি ছিল। টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার দরুন এ খাঁড়ি ও অ্যাপেনাইন পর্বতমালা খুবই স্লথগতিতে আলাদা হচ্ছে। ধারণা করা হয়, মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত এ চ্যুতি রেখা (ফল্টলাইন) ।

এদিকে বৃটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতালি ভ্রমণেচ্ছু নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ইতালির বহু অঞ্চল একটি বড় ধরনের সিসমিক চ্যুতি রেখার ওপর অবস্থিত। দেশটিতে ছোটখাট ভূকম্পন প্রায় প্রত্যাহিক ঘটনা।’

ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের জিওফিজিক্যাল অ্যান্ড ক্লাইমেট হ্যাজার্ডস বিভাগের এমিরেটাস প্রফেসর বিল ম্যাকগায়ারের মতে বর্তমান ভূকম্পনে একেবারেই অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘তত্ত্ব মোতাবেক, এ ধরনের ভূকম্পন প্রতিহত করার সক্ষমতা-সমেত ভবন নির্মাণ করা উচিত। লা’ আকুইলার ঘটনা ও এবারকার কম্পনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ধসে পড়া ভবনই পুরনো। তাই এগুলোতে প্রচলিত মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিহত করার সক্ষমতা যুক্ত করা দরকার।’
তবে তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্য ব্যয়বহুল। আমার সন্দেহ আদৌ এ ধরনের কোনো প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে কিনা। এ জন্য অর্থ ও ইচ্ছা দরকার, যা সবসময়ই পাওয়া যায় না।’
বৃটিশ নাগরিকদের জন্য জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য ইতালি। প্রতি বছর ৩০ লাখ বৃটিশ দেশটি সফর করে। সাধারণত, আগস্টেই বেশি পর্যটক ইতালিতে যায়। এদের বেশির ভাগের গন্তব্য সাধারণত উপকূলবর্তী শহর। অনেকে অ্যাপেনাইনের আশেপাশে ভিলা বা খামারবাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন।


পিএনএস/ বাকিবিল্লাহ্



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন