এইডস প্রতিরোধে ইসলাম

  04-12-2016 06:40AM

পিএনএস, ইসলাম : বিশ্ব এইডস দিবস। ‘আসুন ঐক্যের হাত তুলি : এইচআইভি প্রতিরোধ করি’ স্লোগানে এইডস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইউএন এইডসের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩৪ মিলিয়ন মানুষ এইডসে আক্রান্ত। মরণঘাতী এ রোগে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।

বর্তমান সময়ের আলোচিত মারাত্মক মরণব্যধি হচ্ছে (এইচআইভি) এইডস। এখনো যার কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। ১৯৮১ সালের ৫ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম এইডস (এইচআইভি ভাইরাস) শনাক্ত হয়।

আর এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ১৯৮৪ সালে থাইল্যান্ডে; ১৯৮৬ সালে ভারতে এবং বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয়।

এ ভয়াবহ মরণ ব্যাধির প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৮ সাল থেকে ‘১ ডিসেম্বর’ বিশ্ব এইডস দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আর বাংলাদেশে এইচআইভি-এইডস নিয়ন্ত্রণে ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিরোধ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

এইচআইভি ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে শৃংখলিত জীবন-যাপনের বিকল্প নেই। তাই এইচআইভি ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে শৃংখলিত জীবন-যাপনের তাগিদ দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে রোগ-ব্যাধি দিয়ে থাকেন। আবার রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিশেধকও তিনি বলে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কোনো রোগ মানুষের পাপের তথা সীমালংঘনের কারণেও হয়ে থাকে। যা মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে আসে।

এইডসও বিশ্বমানবতার জন্য এক অভিশাপ। যে রোগের কোনো প্রতিশেধক আজো কোনো বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেনি। এ মরণ ব্যাধি এইডস থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে এবং জাতিকে মুক্ত রাখতে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলার বিকল্প নেই।

তাছাড়া পৃথিবীতে কোনো ধর্মই অবাধ যৌনাচারসহ অযাচিত জীবন-যাপনকে সমর্থন করে না। ধর্মীয় অনুশাসন ও শৃংখলিত জীবন-যাপনই প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্র। এইচআইভি তথা এইডস মুক্ত থাকতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা অত্যন্ত জুরুরি।

এইডস কি? কেন এবং কিভাবে এ রোগের সৃষ্টি হয়? কিভাবে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে? এর পরিণাম কি? এ বিষয়গুলো মানুষকে অবহিত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলেই এইডস-এর মতো মরণ ব্যাধি থেকে সমগ্র জাতি মুক্তি লাভ করতে পারবে।

জনসচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এইডস-এর কারণগুলো সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রত্যেক মানুষের নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব।

ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা
বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে ৫০% এইডস রোগীর বয়স ১৫-২৪ বৎসরের মধ্যে। সুতরাং প্রত্যেক বাবা-মার উচিত তাঁর সন্তানকে নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন সম্পর্কে অবহিত করা এবং ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলার প্রতি তাগিদ দেয়া।

সাধারণত ১৫ বছরের পূর্বে সন্তানরা বাবা-মায়ের সঙ্গেই বেশি থাকে। তাই তাদেরকে ধর্মীয় জীবন-যাপনের প্রতি জোর দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ!, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। (সুরা তাহরিম : আয়াত ৬)

যেহেতু উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণীরা এইডস ব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত। তাই প্রত্যেক বাবা মায়ের উচিত তাদের সন্তানকে এইডস থেকে মুক্ত রাখতে সব সময় তাদের খোঁজ-খবর নেয়া। কোনোভাবেই যেন আদরের সন্তানটি কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর রাখা।

যিনা-ব্যভিচার না করা
যিনা-ব্যভিচার ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা যিনার কাছেও যেও না। কেননা এটি অত্যন্ত অশ্লীল ও মন্দ পথ।’ (সুরা ইসরা : আয়াত ৩২)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান (জিহ্বা) আর দুই ঊরুর মধ্যবর্তী স্থানের (যৌনাঙ্গের) দায়িত্ব নেবে, আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব নেব।’

যেহেতু অবাধ যৌনাচার এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। তাই আল্লাহর নির্দেশ মেনে অবাধ যৌনাচার থেকে মুক্ত থাকাই কুরআন ও হাদিসের অকাট্য নির্দেশ।

পর্দা মেনে চলা
ইসলামে নারী-পুরুষ সবার জন্য পর্দাকে আবশ্যক করা হয়েছে। বেপর্দা ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনে অপর নারীর সৌন্দর্য যেন কোনো মানুষকে যিনার দিকে ধাবিত না করে, সে জন্য ইসলাম পর্দার ব্যাপারে অকাট্য নির্দেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেন, ‘হে নবি! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য পবিত্রতর।’ নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে আর তারা যেন তাদের মাথার ওড়না দ্বারা স্বীয় বক্ষ আবৃত করে রাখে। (সুরা নুর : আয়াত ৩০-৩১)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সুমলমানদের পোশাক পরিধানের উদ্দেশ্য হবে দেহকে আবৃত করা এবং পোশাক পরার পর লজ্জাস্থানসমূহ যেন অন্যের সম্মুখে প্রকাশ না পায়। পোশাক হবে ঢিলাঢালা, ভদ্র ও পরিচ্ছন্ন। (মুসলিম ও মিশকাত)

মদ ও মাদক পরিহার করা
মদ, মাদকসহ যাবতীয় নেশাকে ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। যে জিনিস পান করলে মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পায়, সে সব জিনিস গ্রহণ ইসলামে হারাম। যা মানুষকে অনৈতিক কাজের দিকে ধাবিত করে।

আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ আর কিছু নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। (সুরা মায়িদা : আয়াত ৯০)

সমকামিতা বন্ধ করা
ইসলামে সমকামিতা নিষিদ্ধ। সমকামিতার অপরাধে আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী অনেক জাতিকে তাদের জনপদসহ উল্টিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। যেখানে আজো কোনো প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

কুরআনে এসেছে, ‘তোমরা কি তোমাদের যৌন তৃপ্তির জন্য স্ত্রীদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষের কাছে আসবে? মূলত তোমরা হচ্ছো এক মূর্খ জাতি।’
কুরআনের অন্য জায়গায় এসেছে, ‘তোমরা কামবশত স্ত্রীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো বরং তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’

সুতরাং এইডসমুক্ত দেশ গড়তে সমাজ থেকে নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচার, পতিতালয়, বহুগামিতা ও পরকীয়াসহ নিষিদ্ধ সব কাজ থেকে বিরত থাকা সময়ের দাবি। সে দাবি পুরণে শৃংখলাবদ্ধ জীবন-যাপন করার তাগিদ দিয়েছে ইসলাম।
সচেতনতা বৃদ্ধি

এইডসমুক্ত দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি। তা হলো-
>> ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে মেনে চলা। শিক্ষা ক্ষেত্রের সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
>> যে সব কারণে মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় সে সব বিষয় গণমাধ্যমে তুলে ধরা।
>> বিশেষ করে সর্বজন গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যম হিসেবে খ্যাত মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদেরকে এইচআইভি ভাইরাস তথা এইডস সম্পর্কিত সচেতনতামূলক বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে জুমআর খুতবা ও ওয়াজ-মাহফিল-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে পরিকল্পনামাফিক তুরে ধরার ব্যবস্থা করা।

তাছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাধ্যমে মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডার ধর্মীয় যাজকগণকেও এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করা।
>> সব ধরনের অনৈতিক, অবৈধ ও অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্ক বর্জনে সচেতনামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা।
>> যৌন কৌতূহল জাগে বা যৌনকর্ম সম্পাদনে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এমন কাজ বন্ধ করা। যৌন আবেদনময়ী অশ্লীল উপন্যাস, নোংরা যৌন পত্রপত্রিকা, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর নগ্ন দেহ প্রদর্শনী বন্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখা।
>> পতিতাপল্লী তথা দেহ ব্যবসায় জড়িতদের সম্মানজনক পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করা।
>> বিবাহে সক্ষম ব্যক্তিদেরকে বিবাহের প্রতি উৎসাহিত করা। অন্যথায় সংযম অবলম্বনের বিষয়ে সঠিক ধারণা দেয়া।
>> উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের প্রতি অভিভাবকদের সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি বয়ঃসন্ধিকালে তাদেরকে ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মীয় নীতি-আদর্শ মেনে চলার এবং জানার ব্যবস্থা করা।
>> কোনো রোগীর জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে এইআইভিমুক্ত রক্ত পরীক্ষা করে নেয়া।
>> অপারেশনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের আগে জীবাণুমুক্ত করা।
>> দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের দুধ পান করানো হতে বিরত রাখা।

বিশেষ করে...
যারা এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত; তাদের সঙ্গে উত্তম ও সৌজন্যমূলক আচরণ করা। কারণ এইডস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। সুতরাং তাদের প্রতি সদয় হওয়া, সুস্থ্য, সুন্দর ও নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনে তাদের সহযোগিতা করা ঈমানের অপরিহার্য দাবি।

পরিশেষে..
সুস্থ-সুন্দর-সুনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের কুরআনের বিধান মেনে নিয়ন্ত্রিত জীবন গঠন করা জরুরি। এতে রয়েছে বান্দার কল্যাণের পথ নির্দেশ আবার অকল্যাণের কথাও বলে দেয়া হয়েছে।

সুতরাং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে দুনিয়ার শান্তি এবং আখিরাতের মুক্তি সুনিশ্চিত। এ বিধান মেনে চলার মাঝেই রয়েছে এইডস-এর মতো মরণ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার উত্তম উপায়।

আল্লাহ তাআলা সমগ্র মানবজাতিকে এইডস মুক্ত জীবন গড়তে কুরআনের বিধান মেনে ধর্মীয় অনুশাসনে নিজেকে তৈরি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন