হজের সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা

  23-07-2017 05:02PM

পিএনএস ডেস্ক:কাল শুরু হচ্ছে পবিত্র হজের ফ্লাইট। হজ ইসলামের অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ। এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও সাম্যের প্রতীক। ইসলামের অন্যান্য বিধান থেকে হজের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এতে আর্থিক ও কায়িক শ্রমের সমন্বয় রয়েছে, যা অন্য কোনো ইবাদতে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবছর এখানে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষের সমাগম হয়। প্রতিবছর ‘লাব্বাইকের’ এই মিছিলে শামিল হন বাংলাদেশিরাও।

এমন ভুল যেন না হয়

► অনেকে ভুল করে হজে গিয়ে মুসাফিরের নামাজ পড়ে। অথচ মাসআলা হলো, যদি মক্কা-মিনা-মদিনা মিলিয়ে কেউ ১৫ দিন বা তার বেশি থাকার নিয়ত করে, তাহলে সে মুকিম গণ্য হবে। তাহলে তাকে মক্কা, মদিনা, মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ চার রাকাতই পড়তে হবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৮৭)

► মিনায় ১২ বা ১৩ তারিখ পর্যন্ত থাকতে হয়। এর মধ্যে যদি কোনো দিন শুক্রবার হয়, তাহলে মিনায় জুমার নামাজ পড়তে হবে। (তাতারখানিয়া, পৃ. ৫৫৩)

► হজে গিয়ে অনেক নারী চেহারা খোলা রাখেন। অথচ মাসআলা হলো, চেহারা দেখানো যাবে না, তবে বোরকার নেকাব চেহারার সঙ্গে লাগিয়ে রাখবে না। এর জন্য এমন কিছু ব্যবহার করতে হবে, যাতে করে নেকাব চেহারার সঙ্গে না লেগে থাকে।

► অনেক নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদুল হারামে গিয়ে থাকেন। এতে ভিড় বেশি হয়। ফলে তারা হাজারো পুরুষের ধাক্কা খাচ্ছে, ধাক্কা দিচ্ছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, নারীরা মসজিদে নামাজ পড়ার চেয়ে ঘরে নামাজ পড়া উত্তম। এ থেকে বোঝা যায়, কোনো মহিলা হজ বা ওমরাহে এসে ঘরে নামাজ পড়লে এক লাখের চেয়ে বেশি সাওয়াব পাবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৬৫৯৮, ২৬৬২৬)

► এক শ্রেণির হাজি আছে, যারা সারা দিন মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে থাকে। অথচ প্রাণির ছবি তোলা হারাম কাজ। (বুখারি শরীফ, হাদিস : ৫৯৫০)

► অনেক পুরুষ ইহরাম খোলার সময় দাড়ি মুণ্ডায়। এমন লোকেরা ১০০ বার হজ করলেও তাঁদের হজ কবুল হবে না।

► ‘তালবিয়া’ ব্যক্তিগত আমল। সবাই যার যার ‘তালবিয়া’ পড়বে। দেখা যায়, অনেকে লিডারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তালবিয়া পড়তে থাকে। অথচ এর কোনো প্রমাণ নেই।

► আরাফা ও মুজদালিফার মধ্যখানে ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি ময়দান আছে, যেখানে অনেক টয়লেট ও গাছপালা আছে। এসব দেখে অনেকে এটাকে মুজদালিফা মনে করে এখানে অবস্থান করে। অথচ এটা আরাফার মধ্যে দাখিল নয় এবং মুজদালিফার মধ্যেও দাখিল নয়। এটা ভিন্ন একটা ময়দান। এখানে হজের কোনো কাজ নেই। এখানে মাগরিব ও এশা একত্রে পড়া জায়েজ নেই এবং রাত্রে অবস্থান করাও জায়েজ নেই। বাদ ফজর এখানে অবস্থান করলে উকুফে মুজদালিফাও আদায় হবে না। যারা পায়দল আরাফা থেকে মুজদালিফায় যায়, তাদের অনেকে এ ভুল করে। এতে তাদের ওপর ‘দম’ ওয়াজিব হয়ে যায়, কিন্তু তারা তা না জানার কারণে আদায় করে না। ফলে তাদের হজ হয় না।

► ব্যাংকের মাধ্যমে কোরবানি করানো উচিত নয়। কারণ এতে কখনো কখনো ১০ তারিখে বড় শয়তানকে কংকর মারার আগে কোরবানি হয়ে যায়। আবার কখনো কোরবানি সম্পন্ন হওয়ার আগে মাথা মুণ্ডানো হয়ে যায়। আর এ উভয় ভুলের দরুন তামাত্তু ও কিরানকারীর ওপর দম ওয়াজিব হয়ে যায়। কারণ তাদের জন্য ১০ তারিখে এই তিনটি কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি—এক. বড় শয়তানকে কংকর মারা। দুই. কোরবানি করা। তিন. মাথা মুণ্ডানো। এ জন্য নিজেরা বা বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়ে কোরবানির ব্যবস্থা করা জরুরি।

শেষ সময়ের প্রস্তুতি

► প্রথম কাজ হলো, পাসপোর্ট, বিমানের টিকিট ও তারিখ জেনে নেওয়া। এরপর ম্যানিনজাইটিস টিকা বা অন্যান্য ভ্যাকসিন নিতে হবে। ক্রয় করতে হবে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। কিছু বৈদেশিক মূদ্রা সংগ্রহ করতে হবে। বেশি মালপত্র বোঝা বাড়াবে। যা না হলেই নয়, তা সংগ্রহ করবে। যেমন—পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, টাকা রাখার জন্য গলায় ঝোলানো ছোট ব্যাগ, পুরুষের জন্য ইহরামের কমপক্ষে দুই সেট কাপড় (আড়াই হাত হরের আড়াই গজ এক টুকরা কাপড় আর গায়ের চাদরের জন্য একই বহরের তিন গজ এক টুকরা কাপড়) বাংলাদেশ থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। এদেশ থেকে জিনিসপত্র নেওয়ার আগে একটু সতর্কতার সঙ্গে নিতে হবে। ইহরামের দুই জোড়া কাপড় ছাড়া যাবতীয় জিনিসপত্র মক্কা মদিনায় আরো কম দামে পাওয়া যায়। এক জোড়া জুতা নিলেই ভালো হয়। সঠিক সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য একটা এলার্ম ঘড়ি নেওয়া উচিত। সঙ্গে কিছু শুকনা খাবার এ দেশ থেকে নেওয়া যায়। অনাহৃত মালপত্রের বোঝা না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ, তবে অন্তত একটা করে পিঠে ঝুলানো স্কুল ব্যাগ নেওয়া যায়। এটি বিভিন্ন স্থানে চলাফেরার সময় খুবই প্রয়োজন। নারীরা বোরখা ও জরুরি জিনিসপত্র সঙ্গে নেবেন। এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু, পোশাক ও ওষুধপত্র সঙ্গে নিতে হবে।

► হজ একটা পরিশ্রমের কাজ, যার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, তবে তা মাত্র ৫-৬ দিন।

► বিমানে উড্ডয়নকালে হাতব্যাগে ছুরি, কাঁচি, দড়ি নেওয়া যাবে না। নিবন্ধিত চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ওষুধ নিতে পারবেন না। চাল, ডাল, শুঁটকি, গুড় ইত্যাদিসহ পচনশীল খাদ্যদ্রব্য, যেমন—রান্না করা খাবার, তরিতরকারি, ফলমূল, পান, সুপারি ইত্যাদি সৌদি আরবে নেওয়া যাবে না।

► গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায়, নাকি মদিনায়—প্রথমে তা জেনে নিতে হবে। যদি মদিনায় হয়, তাহলে ঢাকায় ইহরাম নয়। মদিনা থেকে মক্কায় গেলে ইহরাম বাঁধতে হবে। বেশির ভাগ হজযাত্রী আগে মক্কায় যান। যদি মক্কায় যেতে হয়, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগেই ইহরাম বাঁধতে হবে। ইহরাম গ্রহণের পর পার্থিব কাজকর্ম নিষিদ্ধ। যেমন—সহবাস, পুরুষদের জন্য কোনো সেলাই করা জামা, পায়জামা ইত্যাদি পরা নিষিদ্ধ। কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। নখ, চুল, দাড়ি-গোঁফ ও শরীরের একটি পশমও কাটা বা ছেঁড়া যাবে না। কোনো ধরনের সুগন্ধি লাগানো যাবে না। কোনো ধরনের শিকার করা যাবে না। ক্ষতি করে না—এমন কোনো প্রাণি মারা যাবে না।

► বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, বিমানের টিকিট, টিকা দেওয়ার কার্ড, অন্য কাগজপত্র, টাকা, বিমানে পড়ার জন্য ধর্মীয় বই ইত্যাদি গলায় ঝোলানোর ব্যাগে যত্নসহকারে রাখতে হবে।

► বিমান থেকে নামার পর একটি হলঘরে বসার ব্যবস্থা করা আছে। এই হলঘরের পাশেই ইমিগ্রেশন কাউন্টার। ইমিগ্রেশন পুলিশ ভিসা দেখে (ছবি ও আঙুলের ছাপ নিয়ে) পাসপোর্টের নির্দিষ্ট পাতায় সিল দেবেন। তারপর লাল-সবুজ পতাকা অনুসরণ করে ‘বাংলাদেশ প্লাজায়’ যেতে হবে। সেখান থেকে মোয়াল্লেমের গাড়ি মক্কায় যার যার নির্ধারিত বাড়ি পৌঁছে দেবে। মোয়াল্লেমের নম্বর (আরবিতে লেখা) হাতে পরে নিতে হবে। আর বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র গলায় ঝোলিয়ে রাখতে হবে।

জেনে রাখা ভালো

► ১০০০ ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে সঙ্গে রাখা ভালো।

► পুরুষ হজযাত্রীদের জন্য কমপক্ষে ২ সেট ইহরামের কাপড়, ২ সেট পাজামা-পাঞ্জাবি, ২টি লুঙ্গি, ২টি টুপি, ২টি গেঞ্জি, ২ জোড়া স্যান্ডেল, ২টি তোয়ালে/গামছা, ১টি খাবার প্লেট, ১টি পানির গ্লাস, ওষুধ, ২টি রিডিং চশমা, একটি ছোট কাঁচি, টুথ ব্রাশ, পেস্ট, নাইলনের রশি আর নারী হজ যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, বোরকা ও অন্যান্য ব্যবহার্য কাপড় সঙ্গে নিতে হবে।

► হজ যাত্রার তারিখের তিন দিন আগে হজযাত্রীদের আশকোনা হজ ক্যাম্পে আসতে হবে।

► যে হজযাত্রীরা সরাসরি মক্কায় যাবেন, তাঁরা যাত্রার ৬ ঘণ্টা আগে ইহরামের কাপড় পরবেন।

► হাত ব্যাগে ৭ কেজির বেশি মাল বহন করা যাবে না।

► মক্কা-মদিনা পৌঁছার পর লিখিত অনুমতি ছাড়া কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকার নিয়ম নেই। হোটেল বা কারো বাড়িতে রান্না ও কাপড় ইস্ত্রি করা যাবে না।

► বাইরে যাওয়ার সময় একা যাওয়া অনুচিত। সব সময় দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করুন।

► তাওয়াফ/সাঈ ও শয়তানেক পাথর মারার সময় বেশি টাকা পয়সা সঙ্গে নিবেন না।

► সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। এতে পায়ে ফোসকা পরতে পারে। রোদ ঠেকাতে ছাতা ব্যবহার করুন। প্রচুর পানি বা ফলের রস পান করবেন। ডাস্টবিন ছাড়া অন্য কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না।

► শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করলে বাংলাদেশ হজ অফিসের পরিচালিত ক্লিনিকে যোগাযোগ করুন। সেখানে সার্বক্ষণিক চিকিত্সক নিয়োজিত আছেন।

► জিলহজ মাসের ৭ তারিখ রাতে অথবা ৮ তারিখ সকালে মোয়াল্লেমের বাসে মিনা যেতে হবে। সঙ্গে হালকা কাপড়-চোপড় ও প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা নেবেন। নিরাপত্তার স্বার্থে বাকি টাকা-পয়সা মোয়াল্লেমের অফিসে রেখে রসিদ নেবেন।

► মক্কা থেকে পায়ে হেঁটে মিনা আরাফায় যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।

► শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করার সময় দলবদ্ধভাবে যাবেন। পাথর মারার সময় কখনো স্যান্ডেল খুলে গেলে বা পাথর হাত থেকে পড়ে গেলে কোনো অবস্থাতেই ওঠানোর চেষ্টা করবেন না। সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত পাথর রাখবেন।

► সৌদি আরবে রাস্তা পারাপারের সময় দৌড়াবেন না। ডান-বাম দেখে রাস্তা পার হবেন। সৌদি আরবে গাড়ি ডান দিক থেকে চলে।

► দেশে ফেরার সময় ৩৬ ঘণ্টা আগে টিকিট ও পাসপোর্ট জমা করে বিমানের আসন নিশ্চিত করতে হবে।

► জমজমের পানি লাগেজে আনবেন না। ফেরার পথে ঢাকা বিমান বন্দর থেকে দেওয়া হবে

► সৌদি আরবে অবস্থানকালে কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা থেকে বিরত থাকুন।


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন