যারা আকাশ থেকে আসা খাবার খেয়েছে

  12-01-2018 04:19PM

পিএনএস ডেস্ক: আল্লাহ তাআলা অসীম ক্ষমতার মালিক। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। কিন্তু যুগে যুগে কপট অন্তরের অধিকারী মানুষ তা বিশ্বাস করে না। তাই তারা তাদের নবীর কাছে নানা বিষয়ের আবেদন করেছে। এমনকি তারা আসমানি খাদ্যের আবেদনও করেছে। যেমন—হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতি ইহুদিরা এমন দাবি তুলেছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন হাওয়ারিরা বলল, হে মরিয়ম তনয় ঈসা! তোমার পালনকর্তা কি আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করতে সক্ষম? সে [ঈসা (আ.)] বলল, আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১১২) অর্থাৎ আল্লাহর কুদরতের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ কোরো না।

হাওয়ারিদের [ঈসা (আ.)-এর অনুসারী] দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ঈসা (আ.) দোয়া করেন : ‘হে আল্লাহ, আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১১৪) হজরত ঈসা (আ.)-এর দোয়ার জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতরণ করব। কিন্তু যে ব্যক্তি এর পরেও অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অন্য কাউকে দেব না।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১১৫)

আসমানি দস্তরখান প্রসঙ্গে বিভিন্ন বর্ণনা

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজরত ঈসা (আ.) বনি ইসরাইলের উদ্দেশে বলেন, তোমরা ৩০ দিন রোজা রাখো। অতঃপর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। তিনি তোমাদের যা চাও তা দান করবেন। ৩০ দিন রোজা রাখার পর তারা বলল, হে ঈসা! আমরা যদি কারো কাজ করতাম, আমাদের পারিশ্রমিক দিত, আমাদের খাওয়াত। আমরা রোজা রেখেছি, উপবাস রয়েছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যাতে তিনি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা নাজিল করেন। অতঃপর ফেরেশতা খাদ্যভর্তি একটি খাঞ্চা নিয়ে হাজির হন। তাতে ছিল সাতটি রুটি, সাতটি মাছ। তা তাদের সামনে রাখা হয়। অতঃপর তারা সবাই সেখান থেকে ভক্ষণ করে।

হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন ঈসা (আ.)-এর সঙ্গীরা তাঁর কাছে আসমানি খাবার প্রার্থনা করে, তখন তিনি পশমের বস্ত্র খুলে কালো রঙের পায়জামা পরিধান করেন। অতঃপর পায়ের সঙ্গে পা, গোড়ালির সঙ্গে গোড়ালি ও পদদ্বয়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিগুলো একত্রিত করে দাঁড়ান। অতঃপর ডান হাত বাঁ হাতের ওপর রাখেন। তারপর মাথা নিচু করে বিনম্র হয়ে ক্রন্দন করে অশ্রু দিয়ে দাড়ি মোবারক সিক্ত করে দোয়া করেন—হে আল্লাহ! আমাদের রব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। অতঃপর দুটি মেঘ খণ্ডের মাঝে গোলাকার রক্তিম বর্ণের একটি দস্তরখান অবতীর্ণ হয়। মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে। হজরত ঈসা (আ.) তখন দোয়া করেন, হে আল্লাহ! একে রহমত হিসেবে নির্ধারণ করুন। আমার রবের পরীক্ষার বিষয় করবেন না। আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। অতঃপর রুমাল দিয়ে আবৃত খাঞ্চা হজরত ঈসা (আ.)-এর সামনে অবতীর্ণ হয়। তিনি তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। হাওয়ারিও তাঁর সঙ্গে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। তাঁরা তাতে এমন সুগন্ধি অনুভব করেন, যা এর আগে কখনো অনুভব করেননি। হজরত ঈসা (আ.) বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক আবেদ ও পুণ্যবান, সে তা খোলো। আমরা তা থেকে খাব ও আল্লাহর প্রশংসা করব। (তাফসিরে কুরতুবি)

ঈসা (আ.)-এর সঙ্গীরা বলল, হে রুহুল্লাহ! আপনিই এর অধিক হকদার। হজরত ঈসা (আ.) তখন অজুু করে নামাজ পড়েন ও দীর্ঘ মোনাজাত করেন। অতঃপর বসে খাঞ্চাটি খোলেন। এ খাঞ্চা অবতীর্ণের দিবসটি ছিল শনিবার। তাই ইহুদিরা এ দিনকে ঈদের দিন মনে করে।

খাঞ্চায় যেসব জিনিস ছিল তা হলো—

১. কাঁটাহীন তৈলাক্ত একটি ভুনা মাছ।

২. মাছের চতুর্দিকে ছিল বিভিন্ন ধরনের সবজি।

৩. মাছের মাথার কাছে ছিল লবণ ও ঝোল।

৪. লেজের কাছে ছিল পাঁচটি রুটি।

প্রতিটি রুটির একটিতে ছিল পাঁচটি আনার, আরেকটিতে খেজুর, অন্যটিতে জাইতুন। সালাবি (রহ.) বলেন, একটিতে ছিল জাইতুন, আরেকটিতে মধু, আরেকটিতে ডিম, আরেকটিতে ছিল পনির, আরেকটিতে গোশত।

(তাফসিরে কুরতুবি)

মান্না ও সালওয়া

হজরত মুসা (আ.)-এর জাতি ছিল অত্যন্ত দুষ্ট স্বভাবের। তারা আল্লাহ তাআলার কথা মানত না। আল্লাহ তাআলা যখন হজরত মুসা (আ.)-কে আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন, তখন তিনি বনি ইসরাইলের ১২ গোত্রের ১২ জন নেতাকে আমালেকা সম্প্রদায়ের রণাঙ্গনের অবস্থা দেখার জন্য প্রেরণ করেন। বায়তুল মাকদাসের অদূরে শহরের বাইরে আমালেকা সম্প্রদায়ের এ ব্যক্তির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। সে একাই ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, এরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। রাজদরবারে নানা পরামর্শের পর তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে তারা স্বজাতির কাছে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমালেকা জাতির শৌর্য-বীর্যের কথা বর্ণনা করতে পারে। ফলে আক্রমণ করা তো দূরের কথা, এদের দিকে মুখ করার দুঃসাহসও না দেখায়।

বনি ইসরাইলের ১২ জন সর্দার আমালেকা গোত্রের কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়ে ইউশা বিন নুন ও কালিব বিন ইউকান্না ছাড়া অন্যরা সবাই স্বজাতির কাছে সব বলে দেয়, অথচ তাদের সব কথা মুসা (আ.)-এর কাছে বলতে বলেছিলেন। তারা মুসা (আ.)-কে গিয়ে বলল, ‘আপনি ও আপনার পালনকর্তা যান ও উভয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানে বসলাম।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২৪) আল্লাহ তাআলা তাদের এ উক্তির ফলে অসন্তুষ্ট হয়ে ময়দানে ‘তিহ’ (সিনাই উপত্যকায়) যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেই স্থানটি ছিল উদ্ভিদ, বৃক্ষলতা ও পানিবিহীন এক শুষ্ক মরুভূমি। তারা ‘তিহ’ ময়দানে একত্রিত হয়ে আবেদন করে। হে মুসা! সেখানে আমাদের আহারের ব্যবস্থা কিভাবে হবে? তখন আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য মান্না ও সালওয়া নামের আসমানি খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমাদের জন্য মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৫৭)

মান্না ও সালওয়া কী?

মান্না হলো এমন খাদ্য, যা রাতে কুয়াশার মতো পড়ে জমে যেত ও সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হতো। কারো কারো মতে, মান্না হলো ডুমুর। কারো কারো মতে, আঠালো সুমিষ্ট বস্তু। কারো মতে মধু, কারো মতে সুমিষ্ট পানীয়। কারো মতে, পাতলা রুটি।

সালওয়া ছিল এক ধরনের পাখি, যা সূর্যাস্তের পর ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ধরা দিত। তারা এদের গোশত ভক্ষণ করত।

কেন এ খাবার আসা বন্ধ হয়?

ইহুদিদের আসমানি খাদ্য জমা করে রাখতে নিষেধ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা জমা করে রাখত। আবার একসময় তারা মান্না ও সালওয়ার পরিবর্তে পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাকার খাবার দেওয়ার জন্য দাবি জানায়। এতে তারা বিনা পরিশ্রমের আসমানি খাদ্য হারায় ও আল্লাহর শাস্তির উপযোগী হয়।

মায়েদা বা খাঞ্চার অবতরণ ও মান্না-সালওয়ার অবতরণ আল্লাহ তাআলার মহান কুদরতের একটি বড় নিদর্শন।

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন