ইসলাম শিশুদের যে অধিকার দেয়

  27-05-2018 02:03PM

পিএনএস ডেস্ক: মানুষের জীবনে এমন কিছু দুর্লভ মুহূর্ত আসে যা তার মধ্যে একই সময়ে আনন্দ এবং উদ্বেগ নিয়ে আসে। আর সেটি হলো প্রথমবারের মতো সন্তানের মা কিংবা বাবা হওয়ার সংবাদ। মায়ের গর্ভে সন্তান আসার কথা জানার পর সন্তানটি ছেলে না মেয়ে তা জানার জন্যও পিতা-মাতাসহ নিকটাত্মীয়রা খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়েন। এরপর শুরু হয়ে যায় সন্তানের জন্য নাম নির্বাচন করা, ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, সম্ভব হলে শিশুর জন্য আলাদা একটি ঘরের ব্যবস্থা করা, নীল অথবা পিঙ্ক কালার দিয়ে রুমটিকে রাঙিয়ে তোলা, পরম মমতায় শিশুর রুমটিকে সুন্দর ও মনোরম জিনিস দিয়ে সাজিয়ে তোলা। এ সময় পিতা-মাতা উভয়েই তাদের জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জবাব পেতে চান। যেমন : সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর মা কি তার চাকরি চালিয়ে নেবেন নাকি ছেড়ে দেবেন? তিনি কি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন নাকি ফিটার খাওয়াবেন? সংসারে আগত নতুন মেহমানের চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় আছেতো? ইত্যাদি।

কিন্তু যে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরি সে প্রশ্নগুলো নিয়ে আমাদের সমাজের খুব কমসংখ্যক মানুষই ভেবে থাকেন। আর সেই প্রশ্নগুলো হলো : পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের প্রতি এই শিশুটির কী কী অধিকার রয়েছে? সৃষ্টিকর্তা এই শিশুটিকে আমাদের জিম্মায় দিয়ে কী কী দায়িত্ব অর্পণ করেছেন? এই প্রশ্নগুলো অনিবার্যভাবেই আমাদের নিজেদেরকে নিজেদের কাছে করতে হবে এবং শুধু প্রশ্ন করলেই হবে না অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাদেরকে এই প্রশ্নের জবাব পেতে হবে; যদি সত্যি সত্যিই আমরা এমন একটি প্রজন্মের লালন করতে চাই, যারা মানুষ হিসেবে হবে আমাদের চেয়েও অনেক ভালো।

কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কখন থেকে একটি শিশুর অধিকার শুরু হয়? তাহলে মহানবীর (সা.) হাদীস অনুসারে বলবো, এটি শুরুর আগ থেকেই শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, একটি শিশুর জন্মের আগ থেকেই তার অধিকার শুরু হয়ে যায়।

আমরা যখন আমাদের জন্য একজন জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচন করতে যাই তখন থেকেই শিশুর প্রতি আমাদের দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। কেননা, শিশুদেরও অধিকার রয়েছে অধিকতর সৎ এবং মহৎ মা-বাবা লাভ করার; একজন ভালো মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়ার, একজন মমতাময়ী নারীকে মা হিসেবে পাওয়ার; যারা তাদেরকে ভালোবাসবে এবং সত্যিকার ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। পিতা-মাতা যদি সৎ চরিত্রবান না হন তাহলে পৃথিবীতে শিশুর আসা বা জন্ম লাভ করাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একটি শিশু যখন মায়ের গর্ভে ভ্রƒণ অবস্থায় বিরাজ করে তখন এটা তার অধিকার হয়ে পড়ে যে পিতা-মাতা তাকে এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দিবে, তাকে হত্যা করবে না বরং গর্ভে থাকাকালীন সময়ে তাকে যথোচিত নিবিড় পরিচর্যা করবে। এটি সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত অধিকার। এ কারণে ধর্মীয় দৃষ্টিতে শিশু হত্যা মহাপাপ।

গর্ভস্থ শিশুর অধিকার :
আজকাল ব্যাপকভাবে ভ্রুণ হত্যা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে বলা যায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় মানবতা, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার নিয়ে, নৈতিক অধিকার নিয়ে আলোচনা হয় সেখানেও প্রায়ই গর্ভস্থ শিশুর বেঁচে থাকার অধিকারকে অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করা হয়। গত ২৫ বছরে সেখানে এবর্সনের নামে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি ভ্রুণ শিশু হত্যা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও এই প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে; অথচ ইসলাম ধর্মে এটিকে একটি জঘন্য অন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে জানা যায়, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, গর্ভ ধারণের ১২০ দিন পর ভ্রুণে প্রাণ সঞ্চার করা হয়। সুতরাং নির্বিচারে গর্ভপাত ঠিক নয়। যারা অজ্ঞতাবশত বর্বরোচিতভাবে জন্মের আগে বা পরে শিশুদের হত্যা করে, পবিত্র কুরআনে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত, বিভ্রান্ত এবং স্রষ্টার দানের প্রতি অকৃতজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আনআমের ১৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা নিজ সন্তানদের নির্বুদ্ধিতাবশত কোনো প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তাদের যেসব নেয়ামত দিয়েছিলেন সেগুলোকে আল্লাহর ওপর ভ্রান্ত ধারণাবশত নিজেদের ওপর হারাম করে নিয়েছে। নিশ্চয়ই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি।’

এই আয়াতে স্পষ্টতই গর্ভস্থ শিশুকে গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যে ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া গর্ভপাত ঘটিয়ে সন্তান হত্যা করে তাকে জরিমানা করতে বলা হয়েছে। অনেকে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ভ্রুণ হত্যার পক্ষে মত দিলেও সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, গর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করাতো যাবেই না, বরং তাদের খাদ্য-পুষ্টি লাভের অধিকারকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে হবে।

যারা দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করে তাদের উদ্দেশে মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ বলেন, ‘এবং দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না, আমরাই তাদেরকে এবং তোমাদেরকে রিজিক দিয়ে থাকি। নিশ্চিতই তাদেরকে হত্যা করা এক মহাপাপ।’ সূরা আল ইশরা, আয়াত ৩১।

গর্ভস্থ শিশুর জীবন সংরক্ষণ ও পুষ্টি বিধানের জন্য পিতাকে তার সাধ্যমতো সবকিছু করার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। এমনকি ঐ সময় যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায় সে অবস্থায়ও পিতার প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, ‘যখন তারা গর্ভবতী হয়, তখন সন্তান ভূমিষ্ঠের আগ পর্যন্ত তাদের ভরণ-পোষণ তোমাদের বহন করতে হবে।’ সূরা আত-তালাক, আয়াত-৬; সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘শিশুর পিতা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় শিশুর মায়ের ভরণ-পোষণ বহন করবে।’ সূরা বাকারা : আয়াত ২৩৩ এমনকি গর্ভবতী নারী যদি কোনো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে বলেও আদালতের কাছে প্রতিয়মান হয়, তাহলেও সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ রহিত করা হয়েছে যাতে গর্ভস্থ শিশুর ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে। শুধু তাই নয়, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তান যাতে পূর্ণমেয়াদ পর্যন্ত দুধ পান করতে পারে সে কারণে পূর্ণমেয়াদে দুধ পান করার আগ পর্যন্ত নারী অপরাধীর ওপর কোনো দণ্ড কার্যকর করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত হাদীসের উল্লেখ এখানে করা যায়। ইবনে মাযায় উল্লেখিত হাদীসটিতে বলা হয়েছে, একবার আল গাজেদ পার্বত্যাঞ্চলের ফিতাম নামের এক নারী জেনার মতো জঘন্য অপরাধ করার পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়। সে মহানবীর আদালতে এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমি পাপ করেছি, আমাকে শাস্তি দিন। একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সা.) তার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেন এবং বলেন, চলে যাও এবং পরে এসো। কিছুদিন পর নারীটি আবার এসে বলল, ‘হে রাসূল (সা.) আমি পাপ করেছি এবং গর্ভবতী হয়ে পড়েছি। আমাকে শাস্তি দিন।’ আল্লাহর রাসূল একইভাবে তাকে বললেন, ‘ফিরে যাও এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এসো।’ নারীটি ফিরে গেলো এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে কোলে নিয়ে আবার এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল, এই দেখুন আমার পাপের ফসল, আমাকে শাস্তি দিন।’ আল্লাহর নবী পুনরায় নারীটিকে বললেন, ফিরে যাও এবং বাচ্চাটিকে পূর্ণমেয়াদে দুধ পান করানোর পর এসো।

নারীটি তার সন্তানকে পূর্ণমেয়াদে দুধ পান করানোর পর আবার রাসূলের আদালতে আসলো এবং তার ওপর দণ্ড প্রয়োগ করার দাবি করল। আল্লাহর রাসূল (সা.) তখন শিশুটিকে রাষ্ট্রের জিম্মায় নিয়ে নারীটির ওপর দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার নির্দেশ দিলেন।

দেখা যাচ্ছে ইসলাম ধর্ম গর্ভস্থ শিশুর অধিকারের ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে। এমনকি শিশুর জন্ম যদি অবৈধভাবেও হয়ে থাকে তাহলেও তার অধিকার এতটুকু খর্ব হতে দেয় না। কারণ শিশুর অবৈধ জন্মের জন্য শিশুটি নিজে মোটেও দায়ী নয়। তবে তাকে যারা অসম্মানজনক পরিচয় দিয়েছে তাদের শাস্তি পেতেই হবে। এজন্য ইসলামী দণ্ডবিধি অনুসারেই শাস্তি প্রয়োগ হয়ে থাকে। সুতরাং পিতা-মাতার শাস্তির ভার শিশু বহন করতে পারে না। মহানবী (সা.) বলেছেন, কোনো আত্মা অন্যের পাপের ভার বহন করবে না।

নবজাত শিশুর প্রতিপালন :
নবজাত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হবে না ফিডার খাওয়ানো হবে এ নিয়ে পাশ্চাত্য নারীদের মধ্যে বহু বছর ধরে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। অথচ ইসলাম ধর্মে আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগেই বুকের দুধ খাওয়ানোকে শিশুর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর ও উপকারী। যেসব শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় তারা বুকের দুধ বঞ্চিত শিশুদের তুলনায় অধিক স্বাস্থ্যবান হয়, তাড়াতাড়ি বড় হয় এবং অধিকতর স্মার্ট হয়।

বুকের দুধ নিশ্চিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন যেমন শিশুর অধিকার নিশ্চিত করেছেন, তেমনি নিশ্চিত করেছেন মায়ের অধিকার। এমনকি মায়ের অবর্তমানে বা অক্ষমতার কারণে যে মা শিশুকে দুধ পান করাবে সেই দুধ মায়ের অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে।

মায়ের দুধে শিশুর অধিকার :
শিশু যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের খাবার নিজে খেতে পূর্ণ সামর্থ্য অর্জন না করবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিধান ইসলাম ধর্ম দিয়েছে। শিশুর শরীর গঠন ও বেড়ে ওঠার ওপর মায়ের দুধের বিরাট প্রভাব রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর নির্দেশই দেননি, সুনির্দিষ্টভাবে সময়কালও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ২৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মায়েরা তাদের শিশুদের পূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ পান করাবে।’ সুতরাং শুধু মায়ের কর্তব্য হিসেবেই নয়, ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেও শিশুদের বুকের দুধ পান করানো মায়েদের উচিত।

স্তন্যদান মায়ের অধিকার :
যদি সন্তানের পিতা-মাতার মধ্যে বিচ্ছেদ দেখা দেয়, তাহলে মায়ের অধিকার থাকবে পূর্ণমেয়াদ পর্যন্ত শিশুকে দুধ পান করানোর। যদি সন্তানের মা একান্তই না চান কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই পিতার অধিকার থাকবে সন্তানকে অন্য মহিলার দুধ পান করানোর। আবার সন্তান যদি অন্য নারীর স্তন পান করতে না চায় বা স্বামী বেচারার যদি দুধ মা ভাড়া করার সামর্থ না থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে শিশুকে দুধ পান করানো মায়ের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। এক্ষেত্রে পিতাকে মায়ের পূর্ণ ভরণ-পোষণ দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : (তালাক হয়ে যাবার পর) পিতারা যদি চায়, সন্তান পূর্ণ মুদ্দদ কাল পর্যন্ত দুধ পান করতে থাকুক, তাহলে মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। এ অবস্থায় সন্তানদের পিতাকেই প্রচলিত নিয়ম অনুসারে মায়েদের খোর-পোষ দিতে হবে। তবে কারো ওপর তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়; না মায়েদের এজন্য কষ্টে নিক্ষেপ করা উচিত যে, সন্তানতো তারই; আর না পিতাকে এজন্য চাপ দেয়া উচিত যে, সন্তানতো তারই। দুধদানকারিণীর এই অধিকার যেমন সন্তানদের পিতার ওপর রয়েছে; তেমনি রয়েছে উহার উত্তরাধিকারীদের ওপরও। কিন্তু উভয়পক্ষই যদি পারস্পারিক সন্তোষ ও সমঝোতার ভিত্তিতে দুধ ছাড়াতে চায় তাহলে এরূপ করাতে কোনো দোষ হবে না। আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদের অন্য কোনো নারীর দুধ পান করাতে চাও তাহলে তাতেও কোনো দোষ হবে না। তবে শর্ত হলো, এজন্য যে পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট করা হবে তা যথারীতি আদায় করতে হবে। আল্লাহকে ভয় কর। আর জেনে রেখো, তোমরা যাই কর আল্লাহ তার সবই দেখতে পান।’ সূরা আল বাকারা, আয়াত ২৩৩।

এছাড়া সূরা তালাকের ৬নং আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আর যদি তারা গর্ভবতী হয়, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য অর্থ বয় করবে, যদি তারা তোমাদের সন্তানদের স্তন্য দান করে তবে তাদের পারিশ্রমিক দিবে এবং সন্তানের কল্যাণ সম্পর্কে তোমরা সঙ্গতভাবে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করবে। তোমরা যদি নিজ নিজ দাবিতে অনমনীয় হও তাহলে অন্য নারী তার পক্ষে স্তন্য দান করবে।’

শিশুর নাম :
শিশুর আরেকটি মৌলিক অধিকার হলো, তাকে একটি সুন্দর নাম দেয়া। আমাদের সমাজে বর্তমানে এ বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না। প্রায়ই দেখা যায়, ছেলেমেয়েদের অর্থহীন নাম দেয়া হচ্ছে। অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির ওপর খুবই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতাদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে যাতে তারা সন্তানকে একটি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম উপহার দেয়।

একজন মানুষের ওপর তার নামের একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে। সারা জীবন এই নাম তার সাথে থাকে। এমনকি মৃত্যুর পরও তার নাম পৃথিবীতে থেকে যায়। শুধু তাই নয়, তার ছেলেমেয়ে এমনকি অধস্তন বংশধরগণও এই নামটি বহন করে চলে। সুতরাং সন্তানের নাম হেলাফেলার সাথে রাখা উচিত নয়। আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, লোকেরা তাদের পিতৃ পদত্ত প্রকৃত নাম বদল করে নিজেদের পছন্দ মতো নাম রাখছে। কারণ, বাপ-মার দেয়া নামগুলো তাদের পছন্দ নয়, অথবা সে নামগুলো নিয়ে তারা বন্ধু মহলে অস্বস্তি বোধ করে। অতএব, সন্তানের নামটি অবশ্যই অর্থপূর্ণ এবং শ্রুতিমধুর হওয়া উচিত।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের সুন্দর নাম রাখার জন্য পিতা-মাতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হাশরের দিন তোমাকে তোমার এবং তোমার পিতার নাম ধরে ডাকা হবে। সুতরাং নিজেদের জন্য সুন্দর নাম নির্ধারণ কর।’ -আবু দাউদ। শুধু তাই নয়, তিনি কয়েকটি সুন্দর নামের উল্লেখও করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ’র নিকট সবচেয়ে সুন্দর নাম হলো আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রহমান।’-মুসলিম।

মহানবীর সাহাবীরা তাদের সন্তানদের সুন্দর নাম রাখার জন্য সন্তান কোলে করে মহানবীর নিকট চলে আসতেন। তখন মহানবী (সা.) নিজে তাদের নাম রেখে দিতেন। যেমন হযরত আবু মুসা তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘আমি যখন পুত্র সন্তানের বাবা হয়ে ধন্য হলাম, তখন আমি তাকে কোলে করে মহানবীর (সা.) নিকট নিয়ে এলাম। মহানবী (সা.) তার নাম রাখলেন ইব্রাহিম।’ বুখারী।

মহানবী (সা.) অসুন্দর নাম পছন্দ করতেন না। তিনি নিজে কারো কারো নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম রেখেছিলেন। যেমন একজনের নাম ছিল হারব (যুদ্ধ)। মহানবী (সা.) তার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন সিলম (শান্তি)। এমনিভাবে একটি জায়গার নাম ছিল আফিরাহ (নোংরা)। মহানবী সে জায়গার নাম বদল করে রাখেন খাদিরা বা সবুজ। এরকম ঘটনা আরো অনেক আছে।

শিশুকে আদর করে একটি ডাক নামও দেয়া যেতে পারে। আল্লাহর রাসূল (সা.) শিশুদের ডাক নামে ডাকতেন এবং তাদের সাথে কৌতুক এবং খেলাধুলাও করতেন। হযরত আনাস (রা.) বলেছেন, ‘মহানবী (সা.) ছিলেন, লোকদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যবহারকারী এবং সদালাপী। আমার একটি ছোট ভাই ছিল, যে সদ্য দুধ ছেড়েছে। তার ডাক নাম ছিল উমাইর এবং তার একটি পাখি ছিল নুগাইর নামে। মহানবী (সা.) যখনই তাকে দেখতেন তখনই ছড়া কেটে বলতেন, ‘আবু উমাইর/কী করে নুগাইর?

ভালোবাসা ও সহনশীলতায় পরিপূর্ণ বাসস্থান ছাড়াও শিশুর অধিকার রয়েছে সকল ধরনের ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদ থাকার। আমরা অনেকে মনে করি, সন্তানদের ভালো এলাকায়, ভালো বাসায় লালন-পালন করছি, ভালো স্কুলে পাঠাচ্ছি এটিইতো যথেষ্ট। আসলে এসবই যথেষ্ট নয়। ঘরের পরিবেশটিও ভালো হওয়া প্রয়োজন। আমাদের ঘরে ঘরে টেলিভিশন নামে যে যন্ত্রটা রয়েছে, সেটিও হতে পারে সন্তানের ক্ষতির কারণ।

টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভয়ঙ্কর এবং নোংরা দৃশ্য, শব্দ, সহিংসতা ইত্যাদি শিশুর সংবেদনশীল ছোট্ট মনের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। সুতরাং এ বিষয়ে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুদের জন্য উপযুক্ত অনুষ্ঠানই কেবল দেখানো যেতে পারে। সহিংসতা এবং নোংরা দৃশ্য ও শব্দের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বড়দেরও সেসব পরিহার করা উচিত।

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকেও সুরক্ষা দিতে হবে। আল্লাহর রাসূল এমনকি যুদ্ধের সময়ও নারী ও শিশুদের ওপর হাত তোলাকে নিষিদ্ধ করেছেন। বুখারী। মহানবীর (সা.) সাহাবীগণ তাঁর এ নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে মেনে চলতেন। এ প্রসঙ্গে সাহাবী হযরত খাবিব ইবনে আদীর (রা.) দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। তিনি নিজের জীবন দিয়ে মহানবীর (সা.) আদেশকে সমুন্নত করেছিলেন। বুখারী শরীফে তাঁর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। বদরযুদ্ধের পর সাহাবী খাবিব ইবনে আদী বনু আল হারিদ গোত্রের হাতে বন্দী হন। যুদ্ধে হারিদ খাবিবের হাতে নিহত হয়েছিলেন। শত্রুরা খাদিদকে আল হারিদের উঠোনে নিয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের একটি ঘরে বন্দী করে রাখে। মৃত্যুর আগে খাদিদ তাদের হাতে একটি খুর চেয়েছিলেন যাতে তিনি বগলের লোম পরিষ্কার করে পরিচ্ছন্ন হতে পারেন। তারা কেউ সাহাবীর সেই আবেদন রক্ষা করেনি। কিন্তু একটি শিশু সকলের অগোচরে একটি খুর নিয়ে সাহাবীর কাছে চলে যায়। সাহাবী খাবিব ইবনে আদী শিশুটিকে আদর করেন। কিন্তু শিশুটির মা এ দৃশ্য দেখে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। খাবিব মহিলার অবস্থা বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, আপনি ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন, আমি আপনার সন্তানের ক্ষতি করব? কখনও নয়। আমরা এটা করি না। আমরা নারী ও শিশুদের ওপর হাত তুলি না। তিনি শিশুটিকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, সাহাবীরা শিশুদের প্রতি কতটা সদয় ছিলেন।

শুধু তাই নয়, শিশুরা যাতে কোনো বিপদে না পড়ে তার নির্দেশনাও ইসলাম ধর্মে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি কোনো শিশুকে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় বা বিপদশংকুল অবস্থায় দেখে, তাহলে তাকে উদ্ধার করা তার ওপর ফরজ। যদি কেউ কোনো শিশুকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দেখেও উদ্ধার করার চেষ্টা না করে, তাহলে ঐ শিশুর কোনো ক্ষতি হলে তার জন্য ঐ ব্যক্তিই দায়ী হবে। সমাজে অসহায়, এতিম শিশুদের প্রতিপালনের দায়িত্ব ঐ সমাজের বিত্তশালী মানুষের। যদি তারা অপারগ হয়, তাহলে রাষ্ট্রকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে।

আজকের টেস্ট টিউবের যুগে শিশুরা তাদের প্রকৃত পিতা-মাতাকে, নিজের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে না। যদিও তাদের মনে প্রতিনিয়তই এ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আর নিজের বাবা, মা ও পরিবার সম্পর্কে জানার অধিকার তাদের রয়েছে।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন