কিয়ামত আর কত দূর?

  27-07-2019 05:10PM

পিএনএস ডেস্ক : কিয়ামত আরবি শব্দ। অর্থ মহাপ্রলয়, পুনরুত্থান। ইয়াওমুল কিয়ামা—অর্থ কিয়ামতের দিবস। কিয়ামত দিবসের আরো নাম আছে। যেমন—ইয়াওমুল জাজা বা প্রতিদান দিবস, ইয়াওমুল হিসাব বা হিসাবের দিবস, ইয়াওমুল কাজা বা বিচার দিবস, ইয়াওমুদ-দিন বা শেষ বিচারের দিন, ইয়াওমুল হাশর বা সমাবেশের দিন, ইয়াওমুল জাময়ে বা একত্রিত করার দিন, ইয়াওমুল বায়াছ বা পুনরুত্থান দিবস ইত্যাদি।

কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে?

হজরত জিব্রাঈল (আ.) একদা ছদ্মবেশে মহানবী (সা.)-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করেন, কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? মহানবী (সা.) বলেন, জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি থেকে জিজ্ঞাসাকারী অধিক জ্ঞাত নয়। অর্থাৎ কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।

আল্লাহ ইরশাদ করেন, কিয়ামতের জ্ঞান কেবল তাঁরই জানা। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোনো ফল আবরণমুক্ত হয় না এবং কোনো নারী সন্তান প্রসব ও গর্ভধারণ করে না। (সুরা : হা-মিম-সাজদা : ৪৭)

অপর আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ামত কখন হবে? আপনি বলে দিন, এর খবর তো আপনার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে তিনি তা পরিষ্কারভাবে দেখাবেন (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮৭)

মহানবী (সা.) বলেন, গুপ্ত জ্ঞানের বিষয় পাঁচটি—১. কিয়ামত। তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। ২. আগামী দিন কী ঘটবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ৩. কখন বৃষ্টি হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ৪. কার কোথায় মৃত্যু হবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ৫. কখন কিয়ামত হবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। (সহিহ বুখারি)।

কিয়ামতের আলামত

কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে কিছু নিদর্শন দেখা যাবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তারা কি শুধু এই অপেক্ষায় রয়েছে যে কিয়ামত তাদের কাছে হঠাৎ এসে পড়ুক। বস্তুত কিয়ামতের লক্ষণগুলো তো এসেই পড়েছে। সুতরাং এসে পড়লে তারা কিভাবে উপদেশ গ্রহণ করবে? (সুরা : মুহাম্মদ, আয়াত : ১৮)

হজরত জিব্রাঈল (আ.) মহানবী (সা.) থেকে কিয়ামতের কিছু আলামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিয়ামতের একটি আলামত হলো, দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে—অর্থাৎ ছোটলোকের ঘরে বড়লোক জন্মগ্রহণ করবে। আরেকটি আলামত হলো—নগ্ন পাবিশিষ্ট ও বস্ত্রহীন মেষচালক বিশাল বিশাল প্রাসাদ তৈরি করবে এবং এ কাজে তারা পরস্পর গর্ব করবে। অর্থাৎ একসময় যারা গরিব ছিল, পরবর্তী সময়ে তারা ধনী হয়ে অহংকারী হবে। (মিশকাত)

কিয়ামতের আগের সমাজব্যবস্থা

১. সরকারি মালকে নিজের মাল মনে করা হবে। ২. আমানতের মালকে নিজের মালের মতো ব্যবহার করা হবে। ৩. জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে। ৪. ইসলামী আকিদাবর্জিত বিদ্যা শিক্ষা করা হবে। ৫. পুরুষ নারীর অনুগত হবে। ৬. মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হবে। ৭. বন্ধুদের আপন মনে করা হবে। ৮. পিতাকে পর ভাববে। ৯. মসজিদে শোরগোল করবে। ১০. পাপী লোক গোত্রের নেতা হবে। ১১. অসৎ ও নিকৃষ্ট লোকেরা জাতির চালক হবে। ১২. ক্ষতির ভয়ে কোনো লোককে সম্মান করা হবে। ১৩. গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন হবে। ১৪. মদপানের আধিক্য ঘটবে। ১৫. এই উম্মতের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের বদনাম করবে। (তিরমিজি)

কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে—দ্বীনি ইলমের ঘাটতি, নগ্নতা ও উলঙ্গপনা, ফিতনা-ফাসাদের বিস্তার, অশ্লীলতার সয়লাব, হত্যাকাণ্ড, ভূমিকম্পের আধিক্য। এমনকি হত্যাকারী বলতে পারবে না কেন সে খুন করছে। মানুষ অট্টালিকা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। মানুষ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মৃত্যুকে বেশি পছন্দ করবে। ধনসম্পদ এত বেড়ে যাবে যে ধনী সদকা করার মতো কাউকে পাবে না। দুটি বৃহৎ দল একই দাবিতে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হবে। কিয়ামতের আগে ৩০ জন মিথ্যা নবুয়তের দাবিদার হবে। মুসলমানরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনুকরণ ও অনুসরণ করবে। মানুষ জালিমকে জালিম বলবে না, খারাপ কাজ থেকে কেউ কাউকে বারণ করবে না। নারীদের আধিক্য হবে, ৫০ জন নারীর দেখাশোনার ভার একজন পুরুষের ওপর অর্পিত হবে। জিনা, ব্যভিচার ও মদের ছড়াছড়ি হবে। ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ হবে এবং যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হবে। এমনকি জড়পদার্থ পাথরও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে বলবে, হে মুসলমান! দেখো আমার পেছনে এক ইহুদি লুকিয়ে আছে, তাকে হত্যা করো। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

কিয়ামতের বড় আলামতসমূহ

দাজ্জালের আবির্ভাব : কিয়ামতের আগে মানুষকে গোমরাহ করার জন্য পূর্ব দিক থেকে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। মক্কা-মদিনা ছাড়া সে সর্বত্র বিচরণ করবে। দাজ্জালের মাধ্যমে মানুষ দলে দলে গোমরা হয়ে যাবে। তবে খালেস ইমানদাররা তাকে চিনতে পারবে, তার দুই চোখের মাঝখানে কাফের লেখা থাকবে এবং ডান চক্ষু টেরা থাকবে। মহানবী (সা.) বলেন, সমস্ত নবী-রাসুলই তাঁদের উম্মতকে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন, তবে আমি তার সম্পর্কে বলছি, তার ডান চক্ষু টেরা, তোমাদের প্রভু টেরা নন। (বুখারি, হাদিস : ৭৪০৮)

মহানবী (সা.) বলেন, দাজ্জালের সময়কাল হবে ৪০। হাদিস বর্ণনাকারী ইবনে আমর (রা.) বলেন, আমরা জানি না, ৪০ দ্বারা কী ৪০ মাস, নাকি ৪০ বছর বোঝানো হয়েছে। হজরত নাওয়াস ইবন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে চল্লিশের প্রথম দিন হবে এক বছর, দ্বিতীয় দিন হবে এক মাস, তৃতীয় দিন হবে এক সপ্তাহ, অবশিষ্ট ৩৭ দিন হবে আমাদের দিনের মতো (মোট ৩৬৫+৩০+০৭+৩৭=৪৩৯ দিন)। পৃথিবীর ধনসম্পদ দাজ্জালের কুক্ষিগত থাকবে। তার আদেশে বৃষ্টি হবে এবং জমিন থেকে ফসল উৎপন্ন হবে।

হজরত ঈসা (আ.)-এর আগমন : হজরত ঈসা (আ.) কিয়ামতের আগে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করবেন। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তাঁর আগমনের পর পৃথিবীতে ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এরপর তাঁর ওফাত হবে। এক বর্ণনা মতে, তাঁকে রাসুল (সা.)-এর রওজা মুবারকের পাশে সমাহিত করা হবে।

ইয়াজুজ ও মাজুজের আবির্ভাব : কিয়ামতের আগে হজরত নুহ (আ.)-এর পুত্র ইয়াফাসের বংশে ইয়াজুজ ও মাজুজের আবির্ভাব হবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ-মাজুজকে বন্ধনমুক্ত করে দেওয়া হবে এবং তারা উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে (কিয়ামত হবে না)।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৯৬)

তারা বর্বর, নিষ্ঠুর ও জালিম প্রকৃতির। তাদের জুুলকারনাইনের প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে তারা প্রাচীর ভেঙে সমতল ভূমিতে চলে এসে হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ চালাবে। এদের রোধ করার ক্ষমতা কারো থাকবে না।



কিয়ামতের ১০টি বড় নিদর্শন

মহানবী (সা.) বলেন, ১০টি নিদর্শন যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা দেখতে পাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না। তা হলো—১. ধোঁয়া, ২. দাজ্জাল, ২. দাব্বাহ (জমিন থেকে একটি জন্তুর বের হওয়া), ৪. পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (কিয়ামতের ১০০ বছর আগে মাত্র এক দিনের জন্য পশ্চিম দিক দিয়ে সূর্য উদিত হবে), ৫. হজরত ঈসা (আ.)-এর আগমন, ৬. ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন, ৭. পূর্ব দিকের তিনটি ভূমিকম্প, ৮. পশ্চিম দিকে ভূমিকম্প, ৯. আরব উপদ্বীপের ভূমিকম্প, ১০. ইয়েমেন থেকে উত্থিত আগুন, যা মানুষকে তাড়িয়ে সমাবেশের স্থানে নিয়ে যাবে। (সহিহ বুখারি)

কিয়ামত আর কত দূর

কিয়ামতের বড় বড় আলামত এখনো পরিদৃষ্ট না হলেও ছোট ছোট আলামতগুলো এমনভাবে সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে, যা রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই। কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান থেকে মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বদদ্বীনি আচরণ ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। মানুষ থেকে নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। হিংসা, লোভ ও অহংকারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিযোগিতা করে অট্টালিকা নির্মাণ করা হচ্ছে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের পরিবর্তে দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমনের কার্যক্রম গর্বের সঙ্গে করা হচ্ছে। শিরক, বিদআত, নিফাক ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে, মিথ্যা, আমানতের খিয়ানত, ওয়াদা খিলাফ অহরহ হচ্ছে। সন্তান পিতা-মাতার শুধু অবাধ্য নয়, বরং পিতা-মাতাকে খুন করছে। পিতা-মাতা সন্তানকে আদর-স্নেহ দিয়ে মানুষ করার পরিবর্তে নিজেই হত্যা করছে। যা জাহেলি যুগেও করা হতো না। অন্যায়-অবিচার এত প্রকট আকার ধারণ করেছে যে মানুষ অন্যায়কে অন্যায় মনে করছে না। ন্যায়নীতির পরিবর্তে অন্যায়-জুলুম করা হচ্ছে। নারীরা পর্দা করার পরিবর্তে পর্দাহীনতাকে অহংকারের বিষয় বানিয়ে নিয়েছে। সুদ-ঘুষ, মদ, জিনা-ব্যভিচার বেড়ে গেছে। জাহেলি যুগের মতো সুদকে ব্যবসার ন্যায় হালাল মনে করা হচ্ছে। ঘুষকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হচ্ছে। মদপানকে তুচ্ছ করে দেখা হচ্ছে। পাঁচ বছরের বালিকা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুবতীরা যুবকদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। সমাজে সৎ ও নেককার লোকেরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। অসৎ ও দুষ্ট লোকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। বদকর্মে পৃথিবী টইটম্বুর হয়ে যাওয়ার ফলে বলতে হয় কিয়ামত আর কত দূর। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের আগে অজ্ঞতা বেড়ে যাবে, ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, মানুষের হৃদয় কঠিন হয়ে যাবে এবং মারামারি, হত্যাযজ্ঞ বেড়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি)

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন