অবৈধ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন বিচারকও

  22-03-2017 08:36AM


পিএনএস ডেস্ক: দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে অবৈধ লেনদেন হয়। সুপ্রিম কোর্টের তদন্তেই এমন কয়েকটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মেলে বলে জানা গেছে। এ লেনদেনের প্রক্রিয়ায় জড়িত আদালতের কিছু অসাধু কর্মচারী, এমনকি কোনো কোনো বিচারকও।

সারা দেশে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি বিচারক দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের মধ্যে অভিযোগ সামান্য কয়েকজনের বিরুদ্ধে। তবু এসব অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে কর্তৃপক্ষ। কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বিভাগীয় মামলাও রুজু হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এমন কিছু অভিযোগ রয়েছে। কিছু বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বিভাগীয় মামলাও হয়েছে। তবে প্রতিরোধ করার জন্য আমরা নজরদারি জোরদার করেছি। ’

বিচার বিভাগ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে টিআইবির প্রতিবেদনে একবার উঠে আসে। কিন্তু বিষয়টির পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে না পারায় তা আর বেশি দূর এগোয়নি। ওই সময় ব্যাপক তদন্তের আশা করেছিল জনগণ। কিন্তু তদন্ত করে বিচার বিভাগের কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।

ঢাকার খিলগাঁও থানার একটি নাশকতার মামলায় [নম্বর ৪৭(১) ১৫] দেখা যায়, সুমন নামের এক যুবক দুই বছর ধরে কারাবন্দি। হত্যাচেষ্টা, গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ওই মামলা হয় ২০১৫ সালে। সুমনের নাম দেওয়া হয় এজাহারের এক নম্বরে। এ কারণেই তাঁর জামিন হয় না। অথচ ওই ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে যে আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন তিনিও গ্রেপ্তার হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই জামিন পেয়ে যান। এমনকি তাঁর জবানবন্দি অনুযায়ী অন্য যাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাঁরাও জামিন পেয়ে যান কয়েক দিনের মধ্যেই। সুমনের আইনজীবী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে শুনানিতে বলেন, ‘এই আসামি গরিব, তাই তাঁর জামিন হয়নি। দুই বছর ধরে বন্দি আছেন। ’ যাঁরা সরাসরি জড়িত বলে নিজেরাই স্বীকার করেছেন তাঁদের আগে জামিন হওয়া অস্বাভাবিক বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

একটি হত্যা মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালের ১৬ জুন চার আসামিকে একসঙ্গে জামিন দেন রাজবাড়ীর তত্কালীন জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদুল কবীর। মামলার নথি থেকে দেখা যায়, বালিয়াকান্দি থানার লক্ষণদিয়া গ্রামের বাহাদুর মোল্লাকে হত্যার অভিযোগে আগের বছর ২৩ জুলাই বালিয়াকান্দি থানায় মামলাটি করেন হাবিবুর রহমান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ২০১৩ সালের ৩০ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আসামি সবুর, আমিরুল, বিল্লাল ও ফিরোজ। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার এ চার আসামিকে ১৬ দিনের মাথায় জামিন দেন বিচারক। এ ছাড়া আট বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া দুই আসামি মহির ও আলালকেও একই বছর জামিন দেন বিচারক মাহমুদুল কবীর। ‘ফোর মার্ডার কেস’ হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ীর একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি মোখলেসসহ কয়েকজনকে অস্বাভাবিক জামিন দেওয়ার অভিযোগও ছিল এ বিচারকের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া দুজনকে একসঙ্গে হত্যার একটি মামলায় আদালতে দায় স্বীকারকারী আসামি জামালকে জামিন দিয়ে ওই বিচারক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব জামিন দেওয়ার অভিযোগে রাজবাড়ীর আইনজীবীরা ওই বিচারকের অপসারণ চেয়ে আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্ট বরাবর আবেদন করেছিলেন। পরে বিচারককে বদলি করা হয়।

দেশের বিভিন্ন আদালতেই এমন চিত্র রয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে মামলার জামিন বা আসামির খালাস পাওয়ার ঘটনা নেহাত কম নয়। দেওয়ানি মামলায় সম্পত্তির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বেলায়ও এমন ঘটনা ঘটে। বর্তমানে এ ধরনের ঘটনা কম হলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। বেশ কিছু নিম্ন আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেরও অভিযোগ রয়েছে। সেসব অভিযোগের তদন্ত চলছে। আদালতের মামলা পরিচালনার প্রতিটি ধাপেই রয়েছে দুর্নীতি।

বিচার বিভাগীয় একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোনো কোনো বিচারক ঘুষ দাবি করেছেন এবং কেউ কেউ রায় দেওয়ার আগে মোবাইল ফোনে আসামির সঙ্গে কথা বলেছেন। গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার পর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন। ওই বিচারককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একজন জেলা ও দায়রা জজের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ এসেছে, তিনি ‘মসজিদ নির্মাণের’ নামে চোরাচালানি ও বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে সভা করে তাঁদের কাছে টাকা চেয়েছেন এবং তাঁদের মামলাগুলোতে সুবিধা দিতে অধীনস্থ আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী গত বছর চট্টগ্রাম আদালত পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে এক প্রতিবেদনে তিনি চট্টগ্রামের তখনকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম ও দুই মহানগর হাকিমের অসদাচরণের প্রমাণ পান বলে উল্লেখ করেন। তিন হাকিম আসামিদের জামিন দিয়ে দুর্নীতি করেছেন বলেও প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এক বিচারকের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। বিচারপতির প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই চারজনকেই বদলি করা হয়। একই সময়ে বিচারপতি জিনাত আরা ঢাকার কয়েকজন বিচারকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আনেন। তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অবশ্য কেউ কেউ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।

কক্সবাজারের সাবেক জেলা ও দায়রা জজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা উপার্জন এবং নাইক্ষ্যংছড়ির জামায়াত নেতা তোফায়েল আহমেদের আমন্ত্রণে মত্স্য শিকারে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে গত বছর। এ সম্পর্কে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান জেলা জজ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মো. নুরুল হুদা প্রতিবেদনে বলেন, আসামি তোফায়েলের সঙ্গে কক্সবাজারের সাবেক জেলা জজের ভূরিভোজ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং গুরুতর অসদাচরণ। ওই জেলা জজের জামিন আদেশগুলোতে ‘দুর্নীতির আশ্রয়, বিচারিক অসততা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিফলন’ ঘটেছে বলেও এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়।

নড়াইলের সাবেক জেলা জজ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ২০১০ সালের ২৫ মে এক বিচারকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন মামলায় ওই বিচারক অনিয়ম, অসদাচরণ, দুর্নীতি ও অবিচারসুলভ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন।

১৪ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যা মামলার পলাতক আসামিকে আত্মসমর্পণ মাত্রই জামিন এবং পরে খালাস দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন সাবেক বিচারক। অভিযোগ ওঠে অবৈধ লেনদেনের।

ফেনীর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক ২০১১ সালের ৩ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ফেনীর তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালত এবং নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারকের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে একরামুল হক উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। ওই মামলায় একরামুল হকের পক্ষে রায় দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন বিচারক। ঘুষ না দেওয়ায় একরামুল হকের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়। ওই অভিযোগের পর প্রাথমিক তদন্তে বিচারকের ঘুষ দাবির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট বিচারককে সাময়িক বরখাস্ত করে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়।

ঢাকার একজন সহকারী জজের বিরুদ্ধে আবুল কাশেম নামের এক বিচারপ্রার্থী ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর অভিযোগ করেছিলেন, বিচারক মামলার আদেশ দেওয়ার জন্য একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করে অন্যায় আবদার করেন। অভিযোগ পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয় ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল।

মাদারীপুরের তত্কালীন জেলা ও দায়রা জজের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় ছয় বছর পলাতক থাকা আসামিকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে জামিন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১০ সালে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগটি করেন মামলার বাদী খোকন মোল্লা। বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয় মন্ত্রণালয়কে।

চট্টগ্রামের প্রথম সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের এক বিচারকের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ করেন দামপাড়ার বিচারপ্রার্থী মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ। একই বিচারকের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলার বিচারপ্রার্থী খন্দকার ফরহাদ উদ্দিনও অনিয়মের অভিযোগ করেন জেলা জজ বরাবর। ওই অভিযোগও সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। ওই বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়।

বিভাগীয় মামলাগুলোর তদন্ত এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। গত এক বছরে অন্য অভিযোগে পাঁচ বিচারককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

২০১৫ সালে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের কয়েকজন কর্মচারী মিলে ৭০টিরও বেশি মামলায় শতাধিক আসামির জামিন আদেশ পাঠিয়েছিলেন কারাগারে। জানা যায়, ওই আদালতের বিচারকের সই জাল করে ভুয়া জামিননামা তৈরি করে কারাগারে পাঠানোর পর আসামিরা মুক্তি পান। পরে মামলার ধার্য তারিখে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির না করায় বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিতে আসে। এ ঘটনায় ওই আদালতের পিয়ন শেখ আবু মো. নাঈমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জামিননামা কারাগারে পাঠিয়ে আসামিদের মুক্তির ব্যবস্থা করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে প্রশাসনের পক্ষে নাজির ওবাইদুল হক আকন্দ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলার আসামি করা হয় পিয়ন নাঈম, পেশকার মো. মোসলেউদ্দিন এবং তাঁদের অন্য এক সহযোগীকে। সে বছরই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতির বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিলেন নাঈম। পরে আদালতেও স্বীকারোক্তি দেন তিনি। তিনজনের বিচার চলছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আদালতের হিসাব অনুযায়ী ৭০টিরও বেশি মামলার আসামিদের ভুয়া জমিননামা কারাগারে পাঠিয়ে মুক্তির ব্যবস্থা করেন ওই কর্মচারীরা। জানা গেছে, পিয়ন নাঈম আইনজীবীদের বলতেন, ‘টাকা হলে বাঘের দুধও মেলে, আর জামিন মিলবে না!’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, সিনিয়র আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ওই আদালতে যা ঘটেছে তা হলো জামিন আদেশ বিক্রি। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন