খালাস পায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মামলার আসামি

  26-08-2016 07:16AM



পিএনএস: ২০ বছরের বেশি সময় আগের ঘটনা। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জমির উদ্দিনকে। গত বছর মার্চে ঘোষণা করা হয় এ মামলার রায়। এতে খালাস পান চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার নাসির উদ্দিন। এর আগে সঠিক তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে চট্টগ্রামের আলোচিত গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিসহ আরো তিনটি হত্যা মামলায় খালাস পান নাসির। হত্যাসহ ৩৬টি মামলার মধ্যে ১৬টিতেই খালাস পেয়েছে এই আলোচিত সন্ত্রাসী।

এমন উদাহরণ রয়েছে আরো অনেক। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষীর গরহাজির, সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থতার কারণে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধের সংখ্যাগরিষ্ঠ মামলাতেই খালাস পেয়ে যায় আসামিরা। মামলার তদন্ত কার্যক্রমকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা বা কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন জেষ্ঠ আইনজীবীরা। একই সঙ্গে অপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্ত আসামিরা কেন খালাস পান, সেই কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে একটি কমিশন গঠনের কথাও বলেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে ফৌজদারি মামলায় অনেক ক্ষেত্রে বিচার বিভ্রাট ঘটে। বিচার বিভ্রাটের কারণে দোষী ব্যক্তি যেমন খালাস পেয়ে যান, তেমনি নির্দোষ ব্যক্তিরও সাজা হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন থানায় যে পুলিশ কর্মকর্তা থাকেন তারাই মামলা তদন্ত করেন। কিন্তু তারা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাজনিত কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের পক্ষে প্রচুর সময় নিয়ে তদন্ত সম্ভব নয়। ফলে শেষ পর্যায়ে একটি দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আসামিদের আদালতে বিচারের সম্মুখীন করেন তারা। সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে বেশিরভাগ মামলায় আসামিরা খালাস পান- এমন উল্লেখ করে প্রবীণ এ আইনজীবী বলেন, এমনও দেখা গেছে, একই মামলা ৩-৪ জন তদন্ত করেন। তাই আমি মনে করি, ফৌজদারি মামলায় সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে একটি ভিন্ন তদন্ত সংস্থা দরকার। তারা বিভিন্ন থানায় শুধু মামলার তদন্তকাজে নিয়োজিত থাকবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সভ্য দেশে অপরাধীরা সাজা পাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশে ফৌজদারি অপরাধীদের ক্ষেত্রে বিচারে শতকরা হিসাবে ৮০ ভাগ আসামি খালাস পায়। এ বিষয়টি আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। বিষয়টি অনুধাবন করে সরকারকে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে উল্লেখ করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এটি শুধু এক বা দুজনে মিলে সমাধান সম্ভব নয়। সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে একটি কমিশন গঠন করে কেন বেশিরভাগ আসামি খালাস পান তা নিয়ে কাজ করা উচিত।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এর সুবিধা পান আসামিরা। একই সঙ্গে সাক্ষী হাজির করতে না পারা, ভয়ে সাক্ষীদের আদালতে না আসার কারণেও আসামিরা খালাস পান। তারা বলছেন, মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউশনের। কিন্তু প্রসিকিউশন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আন্তরিকভাবে কাজ করে না। ফলে আসামিপক্ষ এ সুবিধা নিয়ে মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান। আইন কমিশনের সদস্য ড. শাহ আলম বলেন, অভিযোগ থাকার পরও নানা কারণেই আসামিদের সাজা হয় না। প্রচলিত যে ফৌজদারি আইন রয়েছে তাতে বিচার নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায়। যে কারণে এ সুবিধাটা আসামিপক্ষ নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় আসামির দোষ প্রমাণের জন্য সাক্ষী খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু বেশিরভাগ মামলাতেই সাক্ষীদের
সঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন করা যায় না। ভয়ভীতির কারণেও সাক্ষীরা আদালতে আসতে চান না। আর কে কিভাবে মামলা উপস্থাপন করছেন এটির ওপরও মামলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।

সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, অপরাধী যদি খালাস পান তারা তখন সমাজে প্রতিশোধমূলক শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে ভিকটিম যদি দুর্বল হয় তাহলে ভিকটিমের ওপর আবারও আক্রমণ করার প্রবণতা অপরাধীদের মধ্যে কাজ করে। এক্ষেত্রে ভিকটিমকে আইনি, নিরাপত্তাসহ সকল সুবিধা দেয়া দরকার। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এমন অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দেশে প্রচলিত আইনকে আরো যুগোপযোগী করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন ও অপরাধের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এলিনা খান বলেন, আমাদের দেশে ফৌজদারি অপরাধের ৮০ ভাগ মামলায় আসামি খালাস পান। এটি বেশিও হতে পারে। তিনি বলেন, যেকোনো ফৌজদারি মামলায় প্রসিকিউশনকেই প্রমাণ করতে হয় আসামি দোষী। তার ওপর দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনের ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পায় আসামিরা। আর মামলা দায়ের থেকে শুরু করে এফআইআর, তদন্ত, অভিযোগপত্র দাখিল, সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণে প্রচুর ফাঁক থেকে যায়। যে কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে প্রসিকিউশন সংশ্লিষ্টদের আরো আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। এলিনা খান জানান, চট্টগ্রামের রাউজানে থানার মধ্যে সীমা রানী ধর্ষণ মামলায় রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, বাদী, সাক্ষীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা প্রসিকিউশনের মাধ্যমে আসামিদের সহায়তার চিত্র ফুটে ওঠে। এ প্রসঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি মানবাধিকার সংগঠনের একজন নেত্রী বলেন, আসামিরা খালাস পেলে কথা উঠে। কিন্তু কী কারণে খালাস পেলো সেটি খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না। তিনি বলেন, থানা থেকে আদালত পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করার কথা প্রসিকিউশন সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু দেখা যায় প্রসিকিউশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা আসামির দোষ প্রমাণে শক্তিশালী কোনো ভূমিকা নেন না। যে কারণে আসামিরাও এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পান। তাই আসামির দোষ প্রমাণে প্রসিকিউশনকেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি পুরনো আমলের ফৌজদারি আইন সংশোধনেরও প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দেন এ মানবাধিকার নেত্রী।


পিএনএস/ বাকিবিল্লাহ্



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন