জৈন্তা রাজার দেশে

  29-09-2016 07:38AM



পিএনএস:বাংলাদেশের কতটুকুইবা দেখেছি আমরা। কতটুকুইই বা জানি। এখানে কত মানুষের কত ভাষা। ভিন্নতাও চলনে-বলনে। কোথাও পাহাড়, কোথাও নদী, কোথাও ধূ ধূ প্রান্তর। দক্ষিণ দিকের মানুষের জীবিকা যেমন নদী আর সাগরে। তেমনি দেশের মধ্যভাগ এবং উত্তরে কৃষিখাতে। বিচিত্র এ দেশে বিভিন্নভাবে বৈচিত্র্য থাকলেও বাংলা ভাষার উচ্চারণে সবাই এক ও অভিন্ন। ভাটিয়ালি ভাওয়াইসহ নানা গান আর কিচ্ছায় আমাদের দেশ বিশ্বের কাছে চিরদিনই চীর সবুজ। এ দেশের সন্তান হয়ে তাইতো গর্ব হয় আমার। পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম সিলেটে। সিলেট থেকে জাফলং ৬৫ কিলোমিটার দূরে। জাফলং জিরো পয়েন্টের একপাশে ভারতের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। অন্যপাশে বাংলাদেশের পিয়াইন নদী। জাফলং যাওয়ার পর চোখে পড়লো ডিঙি নৌকা। সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের ফাঁক-ফোকরে ছোট-বড় ঝর্ণা। পাহারের নিচে চলছে পাথর কুড়ানিদের উল্লাসধ্বনি। যেদিকে তাকাই সুন্দর আর সৌন্দর্য জ্যোৎস্না ধারার মতো উছলে পড়ছে। এ সৌন্দর্যের ভাগাভাগি করে নিচ্ছে বাংলাদেশ আর ভারতের মানুষ। এখানে ভাব জমছে দুই দেশের পর্যটকদের মাঝে। একে অপরের সঙ্গে হাত মেলায় জিরো পয়েন্টে। ওদের দেখা হয় কথা হয় ছোট ছোট। এভাবেই চলতে থাকে জাফলংয়ে দু’দেশের মানুষের ভাব-বিনিময়। সৃষ্টিকর্তা আপন মনে সাজিয়েছে সিলেটের এই জাফলং জনপদকে। এ এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। নলজুরি জেলা পরিষদ ডাক বাংলো থেকে জাফলং বল্লাঘাট মাত্র ৮ কিলামিটার। এ পথটুকু খানাখন্দে ভরা। রাস্তার পিচ উঠে অনেক জায়গায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও নানা ঝক্কি ঝামেলার মধ্যেও প্রতিদিনই আসছে হাজারো পর্যটক।
জাফলং জিরো পয়েন্টের একপাশে ভারতের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। অন্যপাশে বাংলাদেশের পিয়াইন নদী। পাহাড়ের বুক থেকে অনবরত বয়ে চলছে ঝর্ণা। নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে নানা রঙের নুড়ি পাথর। একটু রোদ পড়লেই ঝলমল করে ওঠে নুড়ি পাথরের ঝাঁক। পানির স্রোতের সোঁ সোঁ শব্দ। দূর থেকে তাকালে মনে হবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘমালা। জাফলংয়ের দুই নদী। ধলাই ও পিয়াইন। এই নদী দুটি চির যৌবন দিয়ে গেছে জাফলংকে। ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে ঘুরে বেড়ায় নানাজাতের মাছ। দেখা যায়, নদীর পানিতে নারী-পুরুষের ডুবসাঁতার। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে এ খেলা।

সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদী। তার ওপরে দুই পাহাড়ের মধ্যখানে ঝুলন্ত সেতু, পাহাড়, পানি, পাথর, ঝর্ণা সবমিলিয়ে জাফলং যেন এক রূপকথার রাজ্য। মেঘালয় পাহাড় থেকে সৃষ্ট এই নদীর পানি কাঁচের মতো স্বচ্ছ। ঘাট থেকে জিরো পয়েন্ট যেতে হয় নৌকা নিয়ে। ১৫ মিনিটের এই নৌকা ভ্রমণ জীবনের সবকিছু বদলে দেয় ওই মুহূর্তে। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, এখানে নদীই মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ শিশু সবাই নদীর পেট থেকে তুলে আনছে নানা আকৃতির পাথর। এ পাথর বিভিন্ন হাত ঘুরে চলে যায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। বছরের পর বছর এই পাথর কুড়িয়েই জীবনধারণ করে এখানকার বিশাল এক জনগোষ্ঠী। জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চোখে পড়বে পাহাড়ের ওপরে ভারতের ডাউকি উপজেলা শহর আর শহরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী ঝুলন্ত ব্রিজ। চোখে পড়বে বিজিবি আর ভারতের বিএসএফ। সন্ধ্যা নেমে এলো। নীরে ফিরছে পাখিরা। তেমনি আমিও ধলাই আর পিয়াইন নদীর কলকল শব্দ ছেড়ে সিলেটের পথে রওনা হলাম। মনে হচ্ছিল আমি এতক্ষণ স্বপ্নে ডুবে ছিলাম। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীন নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। তারপরও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকায় গড়ে উঠে নতুন জনবসতি। আশির দশকে সিলেটের সঙ্গে জাফলংয়ের ৫৫ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এরপর থেকে জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেমীরাও ভিড় করতে থাকেন জাফলংয়ে। এরপর ধীরে ধীরে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয় জাফলং।

যেভাবে যাবেন জাফলং: রাজধানী ঢাকা থেকে সিলেটে আকাশ পথ, রেল পথ ও সড়ক পথ সব মাধ্যমেই যাওয়া যায়। বাস ও রেলে গেলে সকালে যাওয়াই ভালো। বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের সীমান্তঘেষা খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জাফলংয়ের অবস্থান। সিলেট নগরী থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং। সিলেটে থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায়। জাফলং যেতে জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। ঢাকা থেকে যাওয়া আসার জন্য মাইক্রোবাসের ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। তবে রাত সাড়ে ৭টায় শাহজালাল ট্রাভেলসে যাওয়াটাই সুবিধাজনক। হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউজ, বাংলো গড়ে ওঠেনি। জাফলং বল্লাঘাট ও নলজুরীস্থ জেলা পরিষদ উদ্যোগে ১টি ছোট রেস্টহাউজ ও ১টি বাংলো রয়েছে এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে এখানে বেশকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। তারমধ্যে শীর্ষে আছে জাফলং ইন। এছাড়া আছে হোটেল প্যারিস, হোটেল হিলভিউ, হোটেল শাহ আমিন, হোটেল পর্যটন ইত্যাদি। জাফলংয়ে পর্যটকদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে আছে বল্লাঘাটস্থ ক্ষুধা রেস্টুরেন্ট, পিকনিক রেস্টুরেন্ট, নরসিংদী রেস্টুরেন্ট এবং জাহাঙ্গীর রেস্টুরেন্ট। মামার বাজারে আছে হোটেল ঢাকা বিক্রমপুর, দিরাই মনি রেস্টুরেন্ট, নাজিয়া রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি।


পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন