জরিপে বিস্ময়কর তথ্য: ৫৬ শতাংশ মানুষ জানে না স্বাধীনতা দিবস কবে

  18-10-2016 09:16AM



পিএনএস ডেস্ক: বাঙালির সবচেয়ে গর্বের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসে দেশজুড়ে থাকে নানা আয়োজন। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে বাংলাদেশের অর্জনও কম নয়। তবে এসব অর্জনের পরও পরিকল্পনা কমিশনের এক জরিপে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার ভয়াবহ চিত্র। জরিপে দেখা গেছে, স্বাধীনতা দিবস কবে জানে না ৫৬ শতাংশ, বিজয় দিবস কবে জানে না ২৪ শতাংশ মানুষ। শুধু তাই নয়, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কেও জানা নেই ৬১ শতাংশ মানুষের। ২৫ মার্চের কালরাত সম্পর্কে জানে না ৪০ শতাংশ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে জানে না ৩৪ শতাংশ এবং সাত বীরশ্রেষ্ঠ সম্পর্কে জানে না ৫২ শতাংশ মানুষ।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩৫টি বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ জরিপ চালায়। গত জুন মাসে প্রকাশিত জরিপের তথ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদরা। তাদের বক্তব্য, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়, এমনটি বিস্ময়কর। এ জন্য তারা দায়ী করেছেন ইতিহাস চর্চায় সাধারণ মানুষের উদাসীনতা ও চলমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০২ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশে ৩৫টি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। যার মধ্যে ঢাকা, হবিগঞ্জ, বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, নীলফামারী, যশোর, ফরিদপুর, নাটোর, বগুড়া, শেরপুর ও গাইবান্ধা এলাকার ১২টি স্মৃতিস্তম্ভের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সে প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওই জরিপে ৫৭৬ জনের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্যে ২৯১ পুরুষ ও ২৮৫ জন নারী। ১৬ থেকে ২৯ বছরের উত্তরদাতা ৪৫.৪ শতাংশ, ৩০ থেকে ৫৯ বছরের উত্তদরদাতা ছিলেন ৩৭.৩ শতাংশ এবং ষাটোর্ধ্ব উত্তরদাতা ছিলেন প্রায় ১৭ শতাংশ। বেশিরভাগ উত্তরদাতা সর্বনিম্ন পঞ্চম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং ১৩ শতাংশ উত্তরদাতা নিরক্ষর। উত্তরদাতাদের বেশিরভাগ গৃহিণী (২৫.৩%), ছাত্র (২২.২%), চাকরিজীবী (১২.৮%) ও ব্যবসায়ী (১১.৫%)। সমীক্ষায় অল্প
বয়সীদের মধ্যে বেশিরভাগ ছাত্র (৪৭.৭%) এবং বয়স্কদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন গৃহিণী (৩৫.১%)।

জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৫০ শতাংশ লোক সঠিকভাবে বলতে পেরেছেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে অপারেশন সার্চলাইট বা নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু হয়েছিল। প্রায় ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সম্পর্কে জানেন না। তাদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই নারী। প্রায় ৬১ শতাংশ উত্তরদাতা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কী ঘটেছিল তা সঠিকভাবে বলতে পারেননি। শুধু ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা এ প্রশ্নের উত্তরে সঠিকভাবে বলেছেন যে, ওইদিন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রবীণদের তুলনায় ১৬ থেকে ২৯ বছর বয়স্ক উত্তরদাতারা সঠিক উত্তর বেশি দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসের সঠিক তারিখ বলতে পেরেছেন ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা। প্রায় ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা এ প্রশ্নের উত্তর জানেন না বা ভুল উত্তর দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গেও প্রবীণদের তুলনায় কিশোর-তরুণরা সঠিক উত্তর বেশি দিয়েছেন। বিজয় দিবসের সঠিক উত্তর দিয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা। প্রায় ১৪ শতাংশ উত্তরদাতা বিজয় দিবস কবে জানেন না এবং প্রায় ৭ শতাংশ উত্তরদাতা এ প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়েছেন। প্রায় ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা বীরশ্রেষ্ঠদের সম্পর্কে জানেন না বা কী কারণে তাদের বীরশ্রেষ্ঠ বলা হয় সেটিও জানেন না। প্রায় ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন বা বড় অবদান রেখেছেন। ৫৭৬ উত্তরদাতার মধ্যে মাত্র ৪ জন সাত বীরশ্রেষ্ঠের নাম সঠিকভাবে বলতে পেরেছেন এবং ৩১০ জন (৫৪%) উত্তরদাতার মধ্যে একজনও বুদ্ধিজীবীদের নাম বলতে পারেননি। উত্তরদাতাদের ৬৬.২ শতাংশ সঠিকভাবে বলেছেন ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রায় ৩৪ শতাংশ উত্তরদাতা সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। তাদের মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশ মনে করেন, ৭ মার্চ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৫৭৬ জনের মধ্যে ৯৯.৭ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছেন। ৬৬.২ শতাংশ উত্তরদাতা বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে শুনেছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, দেখেছেন বা নিজেই শুনেছেন। প্রায় ৭ শতাংশ উত্তরদাতা বই, রেডিও, টিভি, শিক্ষকদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শুনেছেন।

জরিপের ফলাফলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে সঠিকভাবে ইতিহাসের চর্চা নেই। যার ফলে জরিপে এ ধরনের ফলাফল উঠে এসেছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এ ধরনের ফলাফল আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দেশ যখন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এ ফলাফল রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন সূচকের উন্নতিকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলছে। একদিকে যেমন পড়াশোনার অভ্যাস কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে নেই সাংস্কৃতিক অনুশীলন। ফলে ইতিহাসের সঠিক চর্চা হচ্ছে না।'

জরিপের এ ফলাফলকে 'বিস্ময়কর' অভিহিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, 'এমন সব দিনের কথা না জানার কোনো কারণ নেই। এ দিনগুলো সম্পর্কে পাঠ্যবইয়ে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে, গণমাধ্যমে প্রচার রয়েছে এবং বিভিন্ন দিবস জাতীয়ভাবে পালন করা হয়। এ ধরনের ফলাফল ছাত্রদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে। নিজের দেশ সম্পর্কেই তারা ভুল জানছে। এটাকে মানুষের উদাসীনতা বলেই আমি মনে করি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, '১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ঠিক মতো জানতে দেওয়া হয়নি। যতটুকু জানতে দেওয়া হয়েছে, সেটাও ছিল বিকৃত। পাঠ্যপুস্তকে সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ ছিল না। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে দীর্ঘ সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দাবিদার আওয়ামী লীগও ইতিহাস সংরক্ষণ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।' তিনি বলেন, '১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প গ্রহণ করেছিল এবং একই প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প হিসেবে মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো প্রকল্পই শেষ হয়নি। সেটি হলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার পরিধি বৃদ্ধি পেত।' এ ধরনের সংকট নিরসনে এই ইতিহাসবিদ প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। সূত্র: সমকাল

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন