নির্মম আত্মহনন

  21-10-2016 07:31AM

পিএনএস: নৃশংসতা। তাও আবার নিজের ওপর। ছুরি দিয়ে একের এক পোছ। নিজের দু’হাত কেটেছেন অংসখ্যবার। নিজেকে বারবার রক্তাক্ত করে গেছেন। তীব্র যন্ত্রণা উপেক্ষা করে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে নিজের প্রতি এই বীভৎসতা। তাতেও মিটেনি মনোদহন। হতাশা। কিংবা জীবনের প্রতি বিদ্বেষ। শেষে বেছে নিলেন নির্মম আত্মহননের পথ। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে এমন অমার্জনীয় নির্মমতার শেষ পরিণতিতে গলায় ফাঁস দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেন রাবেয়া কুলসুম পিংকি (২৬)। রাজধানীর বাড্ডার আফতাব নগরের ভূঁইয়া বাড়ি এলাকার ৩ নম্বর সড়কের বি ব্লকের ৩৮ নম্বর প্লটের রেডিয়ান্ট দোলন চাঁপার দ্বিতীয় তলার ২/এ নম্বর ফ্ল্যাটে এই আত্মহনন। একই এলাকার বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটির বিবিএ অনুষদে ফিন্যান্সের প্রভাষক পিংকি ঠিক কী কারণে আত্মহত্যা করেছেন তাও জানা যায়নি। এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রমও প্রায় স্থবির। এই আত্মহত্যার পেছনের কারণ কী বা কারো প্ররোচণা ছিল কিনা, তাও হয়তো আর কোনোদিন জানা যাবে না।

লাশের ময়নাতদন্তকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আ. খ. ম শফিইজ্জামান বলেন, রাবেয়া কুলসুম প্রথমে নিজেকে বারবার ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তার দু’হাত ও দু’বাহুতে বহুবার ছুরিকাঘাত করেছে। রক্ত ঝরিয়েছে। ঝুলে পড়ার একদেড় ঘণ্টা আগে থেকেই হয়তো তিনি এ চেষ্টা করেছিলেন। তাতে মৃত্যু না হওয়ায় এবং কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শেষে হয়তো গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা ত্বরান্বিত করেছেন। নির্মম বা যেভাবেই আত্মহত্যা হোক না কেন তা গুরুতর অপরাধ।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হেড অব সাইকোথেরাপি ও সোসাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশন বাংলাদেশের মহাসচিব কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, নিশ্চয় পিংকি কোনো জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন সচেতন মানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে তা তিনি অতিক্রম না করে বরং নিজেকে আক্রমণ করে যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন তা অর্মাজনীয় অপরাধ। নিজেকে এত কাটাকুটির পর তার মনোদহন নিরসন না হওয়াটা অস্বাভাবিকতাও বটে। তারপর তিনি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে মহাপাপ করলেন। আত্মহত্যা তো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। এই গুরুতর স্খলনের মধ্য দিয়ে শুধু তার জীবনাবসানই ঘটাননি, ম্লান হয়ে গেছে তার জীবনের সমস্ত অর্জন।

পুলিশ ও স্বজনদের কাছে জানা যায়, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে পিংকি তার এক বান্ধবীকে ফোন দেয়। ফোনে অনেক কান্নাকাটি করে। আর মুক্তাকে বলে, ‘তোদের আর ফোন দেয়ার দরকার নেই। আমি আমার জীবন আর রাখবো না।’ এরপর ফোন কেটে দেয়া হয়। প্রায় একই সময় পিংকি নিজের ফেসবুকে ‘সবাইকে ধন্যবাদ’ জানিয়ে স্ট্যাটাসও দেন। ধারণা করা হচ্ছে তার তখন ওই বাসায় একা থাকা পিংকি বারবার নিজেকে ছুরি দিয়ে আহত করে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি পিংকির ওই বান্ধবী উত্তরায় থাকা পিংকির ছোট ভাই মো. শরীফকে জানায়। এরপর শরীফ তার এক বন্ধুকে নিয়ে দ্রুত আফতাব নগরে তার বাসায় যায়। এরপর দরজা ভেঙ্গে দেখে সব শেষ। ফ্যানের সঙ্গে নিজের ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলছে পিংকি। তার হাত বেয়ে ঝরছে রক্ত। জামাও রক্তে রঞ্জিত। সেখান থেকে নামিয়েই তাকে দ্রুত নেয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। চিকিৎসক মৃত ঘোষণার পর লাশ নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ওই দিন সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের পর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জানা যায়, পিংকির বাবা জহির আহম্মেদ সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তারা তিন বোন এক ভাই। পিংকির বড় দু’বোন। আর ছোট ভাই মো. শরীফ। বর্তমানে তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের হালিশহরে ৩৪/২৫ নম্বর বাসায় থাকেন। ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে প্রথমে ব্যাংক এশিয়ার যোগ দেন। পরে তা ছেড়ে দেন। গত জানুয়ারিতে যোগ দেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটিতে। এরপর গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব সোস্যাল রিলেশন্স বিভাগের এক প্রভাষকের সঙ্গে তার বাসায় ওঠেন। ওই প্রভাষকের স্বামীও অপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তিনি পড়াশুনার জন্য বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। সমপ্রতি ওই শিক্ষক দম্পতির এক সন্তান হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় পিংকি তার বাসায় উঠে। কিছু দিন আগে থেকে তার বাচ্চা অসুস্থ। এজন্য গত এক সপ্তাহ আগে নবজাতককে নিয়ে রংপুরে বাবার বাড়িতে যান। তখন থেকে বাসায় একা পিংকি। ওই দিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েও যান। ক্লাসও করান। আর রাতে বাসায় আত্মহত্যা করেন।

ফ্ল্যাটটির ভাড়াটিয়া ও তার সমকর্মী ওই প্রভাষক বলেন, পিংকির মধ্যে আমি কোন হতাশা বা অস্বাভাবিক আচরণ দেখিনি। আমি সিনিয়র হওয়ায় কারও সঙ্গে তার প্রেম ছিল কিনা তাও আমার সঙ্গে শেয়ার করেনি। আমি আসার পর কীভাবে আত্মহত্যা করেছে তাও জানি না।

বাড্ডা থানার ওসি এম. এ জলিল বলেন, প্রেমঘটিত কারণে পিংকি আত্মহত্যা করেছে বলে মনে হচ্ছে। তার পরিবার একটি অপমৃত্যু মামলা করে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমরা সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করেছি। অপমৃত্যু হওয়ায় তদন্তের আর তেমন কিছু নেই। তারা যদি আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়া বা অন্য কোন কারণ দেখিয়ে অভিযোগ না করেন তাহলে আমরা কী করতে পারি। মামলার তদন্তকর্মকর্তা আল মামুনও প্রায় অভিন্ন কথা বলেন।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রাশসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. তানভীর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ক্লাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের সে খুবই দক্ষ ও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তার ছোট ভাই মো. শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। কথা বলেন নি তার ভগ্নিপতি বায়েজিদও।


পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন