আজ নাগরিক কবির ৮৮তম জন্মদিন

  23-10-2016 10:08AM

পিএনএস ডেস্ক: ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’-স্বৈরাচারী শাসকের অত্যাচারী চিৎকার শুনে এমনই বাক্য ধ্বনিত হয়েছিল তার প্রতিবাদী লেখায়, তার কণ্ঠে। চেতনায় ছিল বিশুদ্ধ নাগরিক চিত্ত আর হৃদয়ে ছিল দেশের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। তিনিই আমাদের শামসুর রাহমান (১৯২৭-২০০৬)। সমাজসচেতন কবিতার অগ্রপথিক।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ কবির ৮৮তম জন্মদিন আজ। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে তার জন্ম।

বাঙালির প্রিয় এ কবির সৃষ্টিকর্মে শুধু স্বাধীনতাই নয়, সেই সঙ্গে মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, প্রেম, দ্রোহ ও বিশ্বজনীনতাসহ সব কিছুই উঠে এসেছে, যা আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। আর এ কারণেই তিনি বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের একজন এবং আমাদের চলার পথের পাথেয়।

কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন সমকালকে ধারণ করতে, করেছেন প্রতিবাদী চেতনা প্রকাশের দৃঢ় হাতিয়ার। তার অসাধারণ কাব্যভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়েছে পাঠক। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন দেশভাগের ভয়াবহতা, অনুভব করেছেন নিজ বাসভূমিতে পরবাসী হওয়ার দুঃখ। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন মাতৃভূমির প্রতি গভীর টান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তার চিত্তকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল। হৃদয়ের গভীর থেকে মাতৃভাষার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায়-

“তোমাকে উপরে নিলে বল তবে কি থাকে আমার?

উনিশশো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলী বুকে নিয়ে
আছো সগৌরবে মহীয়সী।

সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে...

তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।”

তার ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’ ইত্যাদি কবিতায় পাওয়া যায় স্বাধীনতার প্রতি টান ও দেশের প্রতি মমত্ব। স্বাধীনতার জন্য তার মন হয়েছে আকুল। স্বাধীনতা অর্জনের ভয়াবহতা তিনি চিত্রিত করেছেন কবিতায়। একজন কবির দৃষ্টিতেই শুধু নয় যেন এক বিদগ্ধ নাগরিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সংগ্রামী সত্তার উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রশ্নবাণে তিনি জর্জরিত করেছেন প্রতি বাঙালির হৃদয়। তার দৃপ্ত উচ্চারণ-

‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্য
আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’

আবার অপরদিকে স্বাধীনতার কোমল স্পর্শে তিনি শীতল হয়েছেন। নিজ মাতৃভূমির করস্পর্শে কবিতার প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। নিজের বিপন্ন অস্তিত্বের পুনরুদ্ধার তিনি করতে পেরেছিলেন কবিতার ঝংকারে। স্বাধীনতা তাই তার কাছে-

‘স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’

একদিকে যেমন তিনি স্বাধীনতার পুষ্প সৌরভকে অনুভব করেছেন, তেমনি অপরদিকে শাসকের অত্যাচারকে করেছেন প্রত্যক্ষ। উপলব্ধি করেছেন তার প্রাণের বাংলায় শোষকের রাজত্ব। শাসকের বুটের পদতলে দেখেছেন শ্যামল বাংলাকে। তার মনে হয়েছে-

‘পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক;
নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।’

তিনি ছিলেন সংকল্পবদ্ধ নতুন দিনের সৈনিক। তার কবিতার আর্ত হাহাকার কাব্যগ্রন্থের শিরোনামগুলোই বুঝিয়ে দেয়। অন্যান্য কবিদের মতো শামসুর রাহমানের নায়কেরা চির অন্ধকারের বাসিন্দা নয়। যেখানে আলো প্রবেশ করতে পারে না সেখানেও তিনি খোঁজেন মুক্তির পথ। নতুনের মাঝে দেখেন ভবিষ্যতের আলোকিত পৃথিবী -

‘সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া,

তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।’

শামসুর রাহমান যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এ যুগ স্বভাব কবির নয়, স্বাভাবিক কবির। জীবনানন্দ পেয়েছিলেন সরল প্রকৃতি থেকে ইন্দ্রিয়ঘন প্রকৃতির রং-রূপের সন্ধান, সুধীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ঈশ্বরহীন পৃথিবী, বুদ্ধদেব বসু পেয়েছিলেন প্রেম ও আঁধারকে, শামসুর রাহমান পেলেন নগরজীবনকে। হয়ে উঠলেন প্রকৃত অর্থেই ‘নাগরিক কবি’। সংগ্রামী চেতনায় ধারণ করলেন শহরের প্রতিচ্ছবি।

বিরূপ বিশ্বের নাগরিক হিসেবেও তিনি সচেতন। তার কবিতায় ধ্বনিত হয় সমকালীন বর্বরতা ও হিংস্ররতার চিৎকার। প্রেমিকার সঙ্গে মিলন মুহূর্তেও তার মনে হয় ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণের কথা। সভ্যতার এই কুৎসিত অহংকারের যুগে বেঁচে থাকার চেয়ে তার কাছে সহজ ক্রুশে বিদ্ধ হওয়া। এই অসাধারণ চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলেন বলেই তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অদ্ভুত সব কবিতা যা কেবল সমকালের প্রতিধ্বনি হিসেবেই আন্দোলিত হয়নি, রয়ে গেছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও। আর শামসুর রাহমান আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে গেছেন সমাজসচেতন কবি হিসেবে।

কবির জন্মবার্ষিকী স্মরণে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বনানী কবরস্থানে কবির সমাধিতে পুস্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা, গান ও কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান। আজ সকালে কবির সমাধিতে বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পুস্পমাল্য অর্পণ করবে।

তার স্মরণে বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদ যৌথভাবে একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে আলোচনা, নিবেদিত কবিতাপাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমি ও শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেবেন সংস্কৃতিজন রামেন্দু মজুমদার, কবি রবিউল হুসাইন, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা এবং অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান।

কবির জন্মদিনে চ্যানেল আইতে রাজু আলীমের পরিচালনা ও রোকেয়া প্রাচীরের উপস্থাপনায় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘শিল্প বিনোদন’ এর বিশেষ পর্ব প্রচারিত হবে বিকেল সাড়ে ৫টায়। এ অনুষ্ঠানে কবির সাহিত্য নিয়ে কথা বলছেন ড. আনিসুজ্জামান এবং ভারতের কবি ও অনুবাদক শংকর সেন। প্রিয় কবির জন্মদিনে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং কবি কামাল চৌধুরী।

শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে আবৃত্তি করবেন আসাদুজ্জামান নূর, আল মনসুর ও ডালিয়া আহমেদ। চ্যানেল আইয়ের আর্কাইভ থেকে অনুষ্ঠানে কবির স্বকণ্ঠের আবৃত্তি থাকবে শমী কায়সার এর সঙ্গে। স্টুডিওতে কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করবেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুস এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহাম্মদ সামাদ।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন