আদালত প্রাঙ্গণে ওরা কারা?

  24-10-2016 08:21AM



পিএনএস ডেস্ক: দীর্ঘদিন ধরেই সুপ্রিম কোর্টে যাতায়াত করেন মো. কুদরত-ই-এলাহি খান। পরনে সব সময় সফেদ পাঞ্জাবি-পাজামা। ষাটোর্ধ্ব খান সাহেবের মাথায় সব সময় থাকে সাদা টুপি। কখনও কখনও মুজিব কোটও পরেন। তবে তিনি আইনজীবী নন। নিজেই জানালেন, এলএলবি পাস করে বার কাউন্সিল থেকে আইন পেশার সনদ লাভ করতে দু'বার ব্যর্থ হয়েছেন। তবুও তিনি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা!

টাঙ্গাইলের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতিসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত কুদরত-ই-এলাহী। আইনজীবী না হয়েও নানা কারণে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে তার পরিচিতি আছে। টাঙ্গাইলে তো বটেই, সুপ্রিম কোর্ট এলাকায়ও তার বিশালাকৃতির ছবিসংবলিত পোস্টার টানানো রয়েছে। পোস্টারে আছে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি। পোস্টারে পিতৃপরিচয়ও ঠাঁই পেয়েছে।

'আদালত এলাকায় কী করেন'- জানতে চাইলে তিনি পকেট থেকে একটি বিজনেস কার্ড দিয়ে চলে যান। পরদিন ফোন করা হলে তিনি বলেন, 'আমি আইনজীবী নই।' ঢাকার সাবেক এক সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ করে কুদরত-ই-এলাহি বলেন, আমি তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মামলা-মোকদ্দমা দেখভালের জন্য তাকে আদালতে যেতে হয়। বিজনেস কার্ডে তিনি নিজেকে একটি ইন্স্যুরেন্স, টেক্সটাইল, জুট মিলসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা বলে উল্লেখ করেছেন। এমন আরেকজন মো. জালাল উদ্দিন। তিনি নিজেকে জয়পুরহাটের তা'লীমুল ইসলাম একাডেমি অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচয় দেন। এ পরিচয়ে জালাল উদ্দিন লিফলেটও ছেড়েছেন। সেখানে তিনি বেসরকারি (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি, বেতন, প্রতিষ্ঠান ও কমিটি-সংক্রান্ত ২৯ ধরনের সমস্যার আইনগত পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকেন বলে জানানো হয়েছে। রাজধানীর ২৩/৩ তোপখানা রোডে অবস্থিত সম্রাট হোটেলের তৃতীয় তলায় ৩১০ নম্বর কক্ষে থাকেন জালাল উদ্দিন; সেখান থেকেই তিনি পরামর্শ দেন। তবে পরামর্শ দেওয়াকে তিনি তদবির কিংবা দালালি বলে মানতে নারাজ। তিনি বলেন, 'কোনো শিক্ষক আইনি পরামর্শ চাইলে আমি তা দিয়ে থাকি। হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে বঞ্চিত শিক্ষককে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিই। প্রয়োজনে তাদের আইনজীবী ধরিয়ে দিই।' আইনজীবী না হয়েও কীভাবে আইনি পরামর্শ দিচ্ছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'পরামর্শ দিতে এলএলবি লাগে না; অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।' তবে তিনি এলএলবিতে পড়াশোনা করছেন বলে দাবি করেন। জালাল উদ্দিন আরও জানান, ঢাকায় তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। মাঝে মধ্যে ঢাকায় এলে সম্রাট হোটেলে ওঠেন।

আইনজীবী নন, সহকারীও নন- কুদরত-ই-এলাহী ও জালালউদ্দিনের মতো অনেকেই উচ্চ আদালতের আঙিনায় ঘোরাঘুরি করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করারও অভিযোগ রয়েছে। শুধু বিচারপ্রার্থীরাই নন, তাদের কাছে প্রতারিত হচ্ছেন আইনজীবীরাও।

কয়েকজন বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে মজার সব তথ্য পাওয়া যায়। যাবজ্জীবন দ প্রাপ্ত ছেলের জামিনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সবেদ আলীকে। পরে তিনি দালালের দ্বারা প্রতারিত হন। নাম-পরিচয় জানার পর অনেক চেষ্টা করেও আবুল কালাম নামের ওই দালালকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবেদ আলী জানান, চট্টগ্রামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তার ওই দালালের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। দোকানের পুঁজি ভেঙে দুই কিস্তিতে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেন দালালকে। টাকা নিয়ে দালাল আবুল কালাম পালিয়ে যায়। পরে অন্য এক আইনজীবীর মাধ্যমে তার ছেলে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।

জানা যায়, আইনজীবীর মাধ্যম ছাড়া কোনো বিচারপ্রার্থী মামলা নিয়ে উচ্চ আদালত এলাকায় এলে দালাল বা তদবিরকারকদের খপ্পরে পড়েন। মামলার ফাইল করা, শুনানির জন্য তালিকায় আনা, বেঞ্চে শুনানি করা ও রায় বা আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সমকালের অনুসন্ধানে জানা যায়, দালালরা সাধারণত আইনজীবী পরিচয় দিয়ে এবং নিম্ন আদালতের ক্লার্কের (আইনজীবীদের সহকারী) মাধ্যমে মামলা সংগ্রহ করেন। বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হয়। এরপর একজন আইনজীবীকে স্বল্প পারিশ্রমিক দিয়ে মামলার মুসাবিদা করে দালালরা। পরে মামলাটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়। এখতিয়ার অনুযায়ী সুবিধাজনক বেঞ্চে আইনজীবী দিয়ে শুনানি করানো হয়। আইনজীবীর কাজ এখানেই শেষ। রায় বা আদেশের পর দালালরাই বাকি কাজ করে। এসব কাজে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়।

একাধিক আইনজীবী বলেন, উচ্চ আদালতে ৬০-৭০ ভাগ মামলা দালালের মাধ্যমে তাদের হাতে আসে।

জানা যায়, আদালতের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেঞ্চ কর্মকর্তা, আইনজীবীর সহকারী রয়েছেন দালাল সিন্ডিকেটের তালিকায়। তারা উচ্চ আদালতে জামিন বা খালাস-সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলা বেশি নিয়ে থাকে। জামিনের মামলায় তারা আসামিপক্ষ থেকে নগদ অর্থ পেয়ে থাকে। পাশাপাশি অন্যান্য রিট ও দেওয়ানি মামলারও তদবির করে তারা।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সূত্র জানায়, বর্তমানে তাদের সাত হাজার ২০৭ সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া আরও এক হাজারের বেশি অ্যাডভোকেট উচ্চ আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত। তাদের সহযোগিতায় রয়েছেন প্রায় এক হাজার ৬০০ লাইসেন্সধারী মোহরার। তাদের মধ্যেই ঘাপটি মেরে থাকে দালাল বা তদবিরকারকরা।

দালালের এই সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে হাইকোর্ট এলাকায় দালাল হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আবুল কালাম, দোকানদার মানিক (কুমিল্লা), শামসুল হক (নরসিংদী), দেলোয়ার, সাইদুর রহমান, এনায়েত, জাকির হোসেন (বরিশাল), মোয়াজ্জেম, ইয়াসীন, নাছির, সাইদুল ইসলাম, রিপন (কুমিল্লা), নাইম (বরিশাল), ইউনুস, আবুল হাসেম, হাবিব চৌধুরী, সোহাগসহ আরও অনেকে। আদালত প্রাঙ্গণে নাইমকে পরিচয়পত্র আছে কি-না জানতে চাইলে, 'আছে তো' বলেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও মামলা সংগ্রহের জন্য এসব দালালের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জেলা থেকে মামলা স্থানান্তর করা হয়। জানা যায়, কতিপয় দালালের রাজধানীর সেগুনবাগিচা, তোপখানা রোড, কাকরাইল, বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, আজিমপুর এলাকায় ল' ফার্ম রয়েছে। সেখানে আইনজীবী না থাকলেও আইনি সেবা দেওয়া হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, উচ্চ আদালতে বিভিন্ন ধরনের দালাল রয়েছে। তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দালালদের ভিড় ঠেলে আইনজীবীদের কাছে সরাসরি বিচারপ্রার্থীদের আসা সহজ নয়। সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীও আদালত অঙ্গনে দালালের অভাব নেই বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, অনেক বেঞ্চ অফিসার, আইনজীবী সহকারীরাও দালাল হিসেবে কাজ করছেন। তবে যাদের নাম ভাঙিয়ে দালালি হয় সবচেয়ে বেশি, সেই ক্লার্কদের সংগঠন আইনজীবী সহকারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম দাবি করেন, তাদের সংগঠনে কোনো দালাল নেই; বরং দালালদের উৎপাতে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাবি্বর ফয়েজ বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে দালাল ও টাউট-বাটপার উচ্ছেদ কমিটি রয়েছে। নাম ও ঠিকানা দিয়ে কেউ অভিযোগ করলে প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র: সমকাল

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন