বখাটেরা বেপরোয়া

  26-10-2016 06:41AM


পিএনএস: বখাটেরা বেপরোয়া। একের পর এক তারা হামলা চালাচ্ছে মেয়েদের ওপর। সর্বশেষ ঘটনা সোমবার সন্ধ্যায়। ঘটনাস্থল ঝিনাইদহ। এবার বখাটের ছুরিকাঘাতের শিকার স্কুলছাত্রী পূজা। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় লিপু নামের এক বখাটে ছুরিকাঘাত করে তাকে। মেয়েটি এখন চিকিৎসা নিচ্ছে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে। এ ঘটনায় এরই মধ্যে মামলা করেছেন পূজার বাবা বিপুল কুমার মজুমদার।

গত কয়েক মাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে একের পর এক। একটির রেশ কেটে যাওয়ার আগেই পাওয়া যাচ্ছে নতুন খবর। নতুন করে কোনো নির্মমতার শিকার হচ্ছে কোনো মেয়ে। ছোট্ট মেয়ে সুরাইয়া আক্তার রিশা। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো সে। মায়ের সঙ্গে স্কুল ড্রেস সেলাই করতে যায় দোকানে। সেখানেই টেইলার্সের কর্মচারী বখাটে ওবায়দুল টার্গেট করে তাকে। শুরু হয় নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা।

রিশা বরাবরই এড়িয়ে গেছে তাকে। কিন্তু ওবায়দুলের হাত থেকে রেহাই মিলেনি তার। গত ২৪শে আগস্ট দুপুরে কাকরাইলে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ওবায়দুল। এ ঘটনা তোলপাড় তৈরি করেছিল সে সময়। ঘাতক ওবায়দুল ধরাও পড়ে। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। সুরাইয়া আক্তার রিশার মৃত্যুর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সিলেটে ঘটে বর্বরতা। এবার শিকার কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস। স্কয়ার হাসপাতালে এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে মেয়েটি। বখাটে বদরুল প্রকাশ্যে নির্মমভাবে কোপায় খাদিজাকে। এর আগের মাসে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় স্কুলছাত্রী মিতু মণ্ডল বখাটের হামলায় প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ৮০১ জন, ১০১৪ জন, ৬৪৫ জন, ৪৭০ জন, ৪৪৪ জন এবং ৩২৮ জন নারী ও শিশু উত্ত্যক্তের শিকার হন। এছাড়া পাঁচ বছরে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৩৭ জন নারী ও শিশু। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটেছে ২০৮টি। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে মোট ২৫ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজন আত্মহত্যা করেছেন এবং একজন নিহত হয়েছেন।

এসব পরিসখ্যানই বলে দেয় নারীর ওপর নিপীড়নের ঘটনা কতটা ব্যাপক। বিশ্লেষকরা এর জন্য আইনের শাসন ও সুশাসনের অভাবকেই দায়ী করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারী ও শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতনের কারণ বলতে গেলে একই কথা বলতে হবে। অপরাধীরা শাস্তি দেখে না। বিচারহীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে মনে করেন তিনি। সালমা আলী বলেন, উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটলে অনেক সময় দেখা যায় মেয়েরা পরিবার থেকেও সহযোগিতা পায় না। আর আমাদের নারীরা সমাজ থেকে যতটুকু পাওয়ার কথা সেটা পাচ্ছে না। নারীদের মানুষ না ভেবে ভোগ্যপণ্য মনে করা হয়। এই আইনজীবী বলেন, বর্তমান সময়ে আমরা নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে, কোনো নারী বিপদে পড়লে কিংবা বখাটের আক্রমণের মুখে পড়লে কেউ এগিয়ে আসে না। সালমা আলী বলেন, বখাটেরা ক্ষমতার দিক থেকে এত শক্তিশালী হয় যে, অনেক সময় পরিবার থেকে অভিযোগ করার সাহস পায় না। এ ধরনের অবস্থার পরিবর্তন করতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। সালমা আলী বলেন, বিচারে দীর্ঘতার কারণে প্রতিটা বিষয় দুর্বল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে শাস্তির বিধান করলে নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন অনেক কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, যখন দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক সমস্যা বিরাজ করে তখন আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে না। অপরাধীরা মনে করে দুর্বল নারীরা কিছু করতে পারবে না। তাই নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। এসব ঘটনার মাধ্যমে নারীদের ভয় দেখানো হয়। যেন তারা পিছিয়ে পড়ে যায়। এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, সারা দেশে প্রতিনিয়তই এসব ঘটনা ঘটছে। কিন্তু প্রচারণা কিংবা মিডিয়ায় সেভাবে জায়গা না পাওয়ায় মানুষ জানতে পায় কম। তবে একটা দুটো ঘটনা যখন খুব বেশি আলোচিত হয় তখন অন্য ঘটনাগুলোও সবার নজরে আসতে থাকে। এলিনা খান বলেন, যতদিন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দ্রুত বিচার ব্যবস্থা কার্যকর করা না হবে ততদিন নারী নির্যাতন এবং বিভিন্নভাবে নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হবে না।

এদিকে মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৫৯৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয় ৬৩৫ জন। ২০১২ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে ৫০৮ জন হলেও পরের বছর ২০১৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ৬৯৬ জন। ২০১৪ সালে ৬৬৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৮০৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৮৭ জন নারী ও শিশু। এই পাঁচ বছরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৪৬ জনকে এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৭৩১ জন নারী ও শিশুকে। পিছিয়ে নেই শ্লীলতাহানি এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। বিগত পাঁচ বছরে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে ৯০৬ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫১৭ জন নারী ও শিশু। ২০১০ সালে ১ হাজার ১১৮ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ৮৮৬ জন, ৯০০ জন, ৮২৯ জন, ৮৯৮ জন এবং ৭১৪ জন নারী ও শিশু হত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়া এই পাঁচ বছরে মোট ৩১০ জন নারী ও শিশুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

গাজীপুরে স্কুলছাত্রীর লাশ উদ্ধার
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কতুবদিয়া এলাকায় ৮ম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে পরিবারের দাবি, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মুন্নী আক্তার ওই এলাকার শহীদুল ইসলামের মেয়ে এবং স্থানীয় চাপাইর বিবি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। কালিয়াকৈর থানার ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার সকালে কালিয়াকৈর উপজেলার কতুবদিয়া এলাকায় নিজ ঘরে ৮ম শ্রেনীর ওই ছাত্রীর ওড়না প্যাঁচানো ঝুলন্ত মরদেহ দেখে পরিবার ও স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

তবে তার মৃত্যুটি হত্যাজনিত না আত্মহত্যা সেটি ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে। তবে পরিবারের অভিযোগ, স্কুল ছাত্রী মুন্নী স্কুলে আসায় যাওয়ার সময় একই এলাকার শ্রমিক নেতা আতাউর সরকারের ছেলে আরাফাত রাস্তায় বিভিন্ন সময় উত্যক্ত করতো। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার জের ধরে আজ ভোর রাতে মেয়ের বাড়িতে ঢুকে ওড়না দিয়ে প্যাঁচিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় ।



পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন