মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের দুর্দশা নিয়ে উদ্বেগ, সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান

  09-12-2016 11:45AM



পিএনএস ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থানরত বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বাড়াতে বাংলাদেশকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ। বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কিভাবে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের কাজের সর্বোচ্চ সুযোগ নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারে অবশ্যই উদ্যোগী হওয়া উচিত, তবে এর জন্য যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বিদেশে অবস্থানরত কর্মীরা যাতে সর্বোচ্চ সুরক্ষা পায় তা নিশ্চিত করতে নিজ দেশের নিয়োগদাতা এজেন্সির উপর নজরদারি বাড়ানো, কর্মীদেরকে অন্য দেশে কর্মরত অবস্থায় সুরক্ষা প্রদান এবং দুর্দশার সময় সহযোগিতা প্রদানের সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আগামী ১০-১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এ অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার ইস্যুটি নিয়ে কণ্ঠস্বর জোরালো করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের আইন এবং নীতিমালা গৃহকর্মীদের উপর অবিচার ও বঞ্চনার ব্যাপারগুলোকে হালকাভাবে নেয়। নিয়ন্ত্রণমূলক “কাফালা” ব্যবস্থা, পুরো ভূখণ্ড জুড়েই বিভিন্ন মাত্রায় চালু আছে যা অভিবাসী গৃহকর্মীর ভিসাকে তার নিয়োগদাতার সাথে যুক্ত করে ফেলে। তাদের বর্তমান নিয়োগদাতা অত্যাচারী হওয়া স্বত্বেও, তাদের অনুমতি ছাড়া, নতুন কোন নিয়োগদাতার অধীনে কাজ নিতে পারে না। ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বাঞ্চলীয় অনেকগুলো দেশ, গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। যেখানে কিছু নীতিমালা রয়েছে, সেখানেও খুব সীমিত সুরক্ষা দেওয়া হয়। যদিও অনেক নিয়োগদাতা তাদের গৃহকর্মীদের অধিকারকে সম্মান করে, তবে অন্যান্য গৃহকর্মীরা ভয়াবহ অবিচার ও বঞ্চনার মুখোমুখি হয় যার মধ্যে আছে, শারীরিক নিপীড়ন, বেতন না দেওয়া এবং পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া যাতে তারা কাজ ছেড়ে যেতে না পারে।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসেবমতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী নিয়োগের হার বাড়িয়েছে, এবং সেইসাথে জর্ডান এবং সৌদি আরব এর সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও করেছে। লাখ লাখ বাংলাদেশী নারী মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে। কেবল ২০১৬ সালের জানুয়ারী থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে ১ লাখ মানুষ কাজের জন্য অভিবাসী হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ১০-১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর আয়োজক বাংলাদেশ। এটি এমন এক সম্মেলন যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের দেশের অভিবাসন নীতিমালাসংক্রান্ত বিষয় পরস্পরের সঙ্গে আদান-প্রদান করে। অথচ বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ এখনও নিজেদের গৃহকর্মীদেরই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য নারী অধিকার বিষয়ক গবেষক রত্না বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশ অভিবাসনের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করছে, যদিও দেশটির নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষার নিশ্চিত করার ব্যাপারে খারাপ নজির রয়েছে। বাংলাদেশের উচিত তার কর্মীদের জন্য সর্বোত্তম সুযোগ খোঁজা, কিন্তু তাদেরকে যথাযথ সুরক্ষা ছাড়া বাইরে পাঠিয়ে দেবার বিনিময়ে নয় সে সুযোগ খোঁজা যাবে না।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজেদের শ্রমিকদের অধিকার যথেষ্টভাবে নিশ্চিত করতে এবং নিম্ন মজুরির ইস্যুটির সুরাহা করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী পাঠায় এমন কয়েকটি এশীয় দেশ যেমন- ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল, বিদেশে তাদের গৃহকর্মীদের উপর বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এবং তাদের সুরক্ষা ও বেতনের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে।

নির্যাতন-বঞ্চনা-নিপীড়ন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ওমানে ‘অভিবাসী গৃহকর্মীদের উপর বঞ্চনা’-ইস্যুতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সংগঠনটি। এর জন্য ৫৯ জন কর্মীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিলেন।সেসময় প্রায় সব বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীই বলেছেন যে, নিয়োগদাতারা তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন যে তাদের নিয়োগদাতারা পুরো বেতন দেয়নি, কোনও ছুটি বা বিশ্রাম ছাড়া, জোর করে লম্বা সময় ধরে কাজ করিয়েছে কিংবা যথাযথ খাবার ও থাকার জায়গা দিতে চায়নি। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, তাদের নিয়োগদাতা তাদেরকে শারীরিকভাবে নিপীড়ন করেছে; তাদের কয়েকজন যৌন নির্যাতনের বর্ণনা করেছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ওমানে গৃহকর্মীদের উপর যে অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ সবচেয়ে ভয়াবহ, যার মধ্যে আছে জোরপূর্বক কাজ করানো এবং মানব পাচার। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশীরভাগ মধ্যপ্রাচ্যীয় সরকার, নিয়োগদাতাদের দেশীয় কর্মীদের কাছ থেকে নিয়োগ বাবদ কোনও টাকা গ্রহণ করাকে নিষেধ করে, তবে বাংলাদেশ লাইসেন্সধারী নিয়োগ এজেন্সিগুলোকে, নারী গৃহকর্মী থেকে সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা নেওয়ার অনুমতি দেয়। কিছু বাংলাদেশী নারী যারা ওমানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাথে কথা বলেছেন, তারা জানিয়েছেন যে তারা দালালদেরকে প্রায় এক লাখ টাকা করে দিয়েছেন বিদেশে কাজের জন্য।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, বাংলাদেশের উচিত গৃহকর্মীদের জন্য একটি পদ্ধতি তৈরি করা যাতে তারা মিথ্যা প্রলোভন, বেশী টাকা নেওয়া এবং অন্যান্য বঞ্চনার অভিযোগগুলো বিদেশি মিশনে কিংবা দেশে ফিরে আসার পর লিখিতভাবে জানাতে পারে। বাংলাদেশি মিশনগুলো ও সরকারের উচিত অভিযোগগুলোর তদন্ত করা এবং পাতি দালাল ও নিয়োগ এজেন্সিগুলোকে নির্যাতনের কারনে অভিযুক্ত করা। বাংলাদেশের এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা উচিত যাতে বিদেশে অবস্থানরত কর্মীরা সর্বোচ্চ সুরক্ষা পায়, যার মধ্যে আছে নিজ দেশের নিয়োগদাতা এজেন্সির উপর নজরদারি বাড়ানো, কর্মীদেরকে অন্য দেশে কর্মরত অবস্থায় সুরক্ষা প্রদান এবং দুর্দশার সময় সহযোগিতা প্রদান। মধ্যপ্রাচ্যে নিয়োজিত বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের দুর্দশা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

নিম্ন মজুরি
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, গৃহকর্মীদের জন্য কুয়েত ছাড়া, অন্য কোনও মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশ সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করেনি। অন্য দেশের দূতাবাসগুলো তাদের কর্মীদের জন্য একটা সর্বনিম্ন মাসিক বেতনের স্বীকৃতি চায় কিন্তু বাংলাদেশের নির্ধারণ করা বেতন সর্বনিম্ন যা ১৬,০০০ টাকার কাছাকাছি (২০০ মার্কিন ডলার), অন্যদিকে ফিলিপাইন সর্বোচ্চ বেতন চায় যা প্রায় ৪০০ মার্কিন ডলার। এজেন্সিগুলো প্রায়ই নিয়োগদাতাদের কাছে জাতীয়তার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন বেতনের গৃহকর্মীর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নয়। এর ফলে জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, বাংলাদেশের উচিৎ তার গৃহকর্মীদের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধি করা এবং এমন কর্মপদ্ধতি তৈরি করা যাতে সর্বনিম্ন বেতন এবং অন্যান্য সুবিধাগুলো প্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, উপসাগরীয় দেশগুলিতে, ভারতীয় দূতাবাস তাদের কর্মীদের জন্য নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে প্রায় ৩,০০০ মার্কিন ডলার চায়। নিরাপত্তার জন্য এ অর্থ ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ যখন কোনও নিয়োগদাতা অত্যাচারী হয় তখন গৃহকর্মীর বিমানের ফিরতি টিকেট কেনার এবং বেতনের বাকি থাকা টাকা পরিশোধ করার জন্য ওই অর্থ খরচ করা হয়।

অভিযোগ জানানোর সুযোগের ঘাটতি
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সকল দেশের দূতাবাসগুলো নিজ নিজ কর্মীদের আশ্রয় দেয় যদি তারা অত্যাচারী নিয়োগদাতার কাছ থেকে পালিয়ে আসে, বিশেষকরে নিয়োগদাতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো শুধু কিছু দেশে আশ্রয়ের সুবিধা দেয়। যেহেতু আশ্রয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, তাই অত্যাচারী নিয়োগদাতার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর, নারীদের যাবার জায়গার সংখ্যা খুবই কম। দূতাবাসগুলো যেন আশ্রয়সুবিধা প্রদান করতে পারে এবং এধরণের কর্মীদের সাহায্য করতে সক্ষম হয়, তা বাংলাদেশের নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করে এ মানবাধিকার সংগঠনটি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স কনভেনশন’ চুক্তিকে বাংলাদেশের অনুমোদন করা দরকার। এটি এমন একটি চুক্তি যা নিয়োগ, নিয়োগদাতা নির্ধারণ, ও চাকরি প্রদান এর ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও প্রতারণাপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিরোধ করা ছাড়াও, অভিবাসী গৃহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য- সহযোগিতা নিশ্চিত করে। এ চুক্তিটি ফিলিপাইনসহ ২৩টি দেশ দ্বারা পুনঃস্বীকৃত।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন