চাকরির বাজারে হাহাকার, ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনাও

  10-12-2016 09:40AM


পিএনএস ডেস্ক: ব্যাটারি বিপণনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের ছয়টি পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় গত অক্টোবরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীদের জন্য নির্ধারিত এসব পদের বিপরীতে অনলাইন ও অফলাইনে আবেদন জমা পড়ে ৮২ হাজার ৬৫২টি।

বিজ্ঞাপনদাতা কর্তৃপক্ষ বিপাকে, কীভাবে এই বিপুল আবেদনকারীকে মূল্যায়ন করবে। কর্তৃপক্ষ বিকল্প হিসেবে পরিচিতদের মধ্য থেকে যোগ্যদের নিয়ে নেওয়ার চিন্তা করে। এ পরিস্থিতি শুধু এখানেই নয়, দেশের সরকারি-বেসরকারি যে কোনো চাকরির বিজ্ঞাপনের বিপরীতেই জমা পড়ছে বিশালসংখ্যক আবেদন। অন্যদিকে, একটি বহুজাতিক ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে চাকরিরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ডিগ্রিধারী শাহেদ চাইছেন চাকরি পরিবর্তন করতে। তিনিও আবেদন করেছেন ওই ব্যাটারি বিপণন কোম্পানিতে। বললেন, ‘এখনো ইন্টারভিউর ডাক পাইনি। হয়তো পাবও না। আসলে ডাক পেলেই অবাক হব। কারণ, গত দুই মাসে প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত ১৬৪টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমা দিয়ে দুটিতে মাত্র ডাক পেয়েছিলাম। যারা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন তারা বলেছিলেন জানাবেন। আর খবর নেই। ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে পাস করা রাহাত সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই। পরীক্ষা দিচ্ছেন অনার্সের পর থেকেই। এখন মাস্টার্স শেষে প্রায় দেড় বছর পুরোপুরি চাকরিপ্রার্থী। রাহাতের ভাষায়, ‘আসলে সরকারি এসব চাকরি পেতে হলে মেধার পাশাপাশি উপরের লেভেলে লোক বা টাকা থাকা লাগে। না হলে কোটায় থাকতে হয়। তবুও ভাগ্যে আছে কিনা দেখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে খারাপ লাগে যখন দেখি একসঙ্গে পড়াশোনা করার পরও পরিচিত লোকের মাধ্যমে খারাপ রেজাল্টধারীরও চাকরি হয়ে গেছে। কষ্ট পাই যখন বাড়ি থেকে ফোন করে বাবা জানতে চান [প্রথম পৃষ্ঠার পর] চাকরি হয়েছে কিনা। ’ রাহাতই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৪৪৯ নম্বর কক্ষে সাবেক আবাসিক ছাত্র তারেক আজিজের আত্মহত্যার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তারেক আজিজ ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে দর্শন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কৃষক বাবাব ছেলে তারেক ২০১৪ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েও কোথাও চাকরি পাননি। বিভিন্ন স্থানে চাকরির জন্য আবেদন করলেও টাকার জন্য হয়নি। যেখানেই আবেদন করতেন, সেখান থেকে ৮-১০ লাখ টাকার কথা বলা হতো। টাকার কথা শুনে তারেকের বাবা বলেছিলেন, ‘তাহলে পড়ালেখা না করে আমার সঙ্গে মাঠে কাজ করলেই পারতিস। ’ এমন অবস্থায় গত মে মাসে আত্মহত্যা করেন তারেক আজিজ। প্রায় একই পরিস্থিতিতে গত জানুয়ারিতে আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করা মানিকগঞ্জের ঘিওরের মেয়ে সুক্তি। অবশ্য আত্মহত্যার পাঁচ মাস পরে সুক্তির নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির নিয়োগপত্র এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কক্ষের ঠিকানায়। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪৭ জন বেকার। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক-প্রকৌশলীর হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। নারী চিকিৎসক-প্রকৌশলীর মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩১ শতাংশ। এর পরই আছেন উচ্চমাধ্যমিক ডিগ্রিধারীরা। তাদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০টি সর্বাধিক বেকারত্বের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২। আইএলও ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৪.৩৩ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সাল শেষে মোট বেকার দ্বিগুণ হবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ’৯৫ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে ১ কোটি ৩২ লাখে দাঁড়ায়। অবশ্য বিবিএসসের ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য দিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ যুবক-যুবতী। তারা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী। এ বয়সী ১৯ লাখ ৩৯ হাজার তরুণ-তরুণী কোনো কাজ করেন না। তারা সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজও করার সুযোগ পান না, অথচ সব সময়ই কাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকেন। এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকারের বিপরীতে গেল দুই বছরে মাত্র ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানা যায় বিবিএস প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৫-এ। প্রতি বছর চাকরি পেয়েছেন প্রায় ৩ লাখ। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গত বছর সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলিয়ে মোট ৫০ হাজার ৪৭৩ জনের চাকরি হয়েছে। আর গত পাঁচ অর্থবছরে সরকারি খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ২ লাখ ৬৬ হাজার ২৭৫ জন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সাদ’ত হুসাইন অবশ্য একই সঙ্গে চাকরি ও যোগ্য চাকরিপ্রার্থী দুটিরই সংকট আছে বলে মনে করেন। দীর্ঘ সময় সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা ড. সাদ’ত হুসাইন সম্প্রতি এই প্রতিবেদককে বলেন, কিছু পদের জন্য ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়লেও কোনো কোনো পদের জন্য মাত্র কয়েকটি আবেদপত্র জমা পড়ার নজিরও আছে। আবার বিসিএসের বেশকিছু নিয়োগের ভাইভাতেই ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীদেরও যথাযথ যোগ্যতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হতে দেখা গেছে। যথাযথ কারিকুলাম না থাকা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো এক ধরনের শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানার ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর ৯০ ভাগই সাধারণ শিক্ষায় উত্তীর্ণ। এদর প্রয়োজনীয়তা বেসরকারি খাতে মাত্র ৩০ ভাগ। অথচ বেসরকারি খাতগুলোয় কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ও শ্রমিক শ্রেণির জনবল প্রয়োজন হয় ৭০ ভাগ। পুরনো পদ্ধতি (কারিকুলাম) না পাল্টালে বেকার পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। ’ সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন