আজ নীলিমা ইব্রাহিমের জন্ম দিন

  11-01-2017 10:51AM


পিএনএস: নীলিমা রায় চৌধুরী... যে নামে পরিচিতিঃ নীলিমা ইব্রাহিম... পিতার নামঃ প্রফুল্ল কুমার রায় চৌধুরী... মাতার নামঃ কুসুম কুমারী দেবী... জন্ম-তারিখঃ ১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর (মতান্ত্বরেঃ ১১ জানুয়ারী)। জন্ম-স্থানঃ খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রাম। তিনি ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন... খুলনা করনেশন গার্লস স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে চার বিষয়ে লেটার মার্ক-সহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন (প্রবেশিকা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন... কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৩৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট ইন আর্টস (আই.এ.) এবং এখান থেকেই অর্থনীতি-তে সম্মান-সহ স্নাতক (বি.এ) সম্পন্ন করেন ১৯৪০ সালে... এরপর অর্থনীতি-তে স্নাতকোত্তর শ্রেনীতে ভর্তি হলেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সেটা সমাপ্ত করেন-নি... বরং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে শিক্ষায় স্নাতক (বি.টি.) সম্পন্ন করেন ১৯৪২ সালে... কিন্তু স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করার অদম্য ইচ্ছে থাকায় ১৯৪৩ সালে ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এবং এখান থেকে ১৯৪৫ সালে মেয়েদের মধ্যে প্রথম “বিহারীলাল মিত্র গবেষণা বৃত্তি”-সহ স্নাতকোত্তর (এম.এ) ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি... পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল হাই-এর অধীন “সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক” সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায়-রত হন এবং ১৯৫৯ সালে সেটি সম্পন্ন করেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম গবেষক হিসেবে বাংলায় পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী লাভ করেন... এছাড়াও একই বছর (১৯৫৯ সালে) তিনি ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেস থেকে “ইন্টারমিডিয়েট ইন ফ্রেঞ্চ” বিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেন ।

তিনি ১৯৪৫ সালে ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিক্যাল কোরের ক্যাপ্টেন ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন... তাদের পাঁচ’জন কন্যা সন্তান রয়েছে, এরা হলেন খুকু, ডলি, পলি, বাবলি ও ইতি। তিনি তার কর্ম-জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন... অর্থনীতিতে অনার্স সম্পন্ন করার পর তিনি ১৯৪০ সালে খুলনা করনেশন বালিকা বিদ্যালয়ে চাকুরী নেন এবং পরের বছর তা ত্যাগ করে কলকাতায় পুনরায় পড়াশোনা করার জন্য চলে যান... এরপর লরেটো হাউজে প্রভাষক হিসেবে ১৯৪৩ হতে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে প্রভাষক হিসেবে ১৯৪৪ সাল থেকে বিয়ের পূর্ব (১৯৪৫ সাল) পর্যন্ত চাকুরী করেন... পরবর্তী বছরগুলো তিনি সংসারী হয়ে পড়লেও ১৯৫৬ সালে ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল হাই-এর একান্ত অনুরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৭২ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান (১৯৭২-৭৫)... বাংলা একাডেমীর অবৈতনিক মহাপরিচালক (১৯৭৪-৭৫)... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ (১৯৭১-৭৭) ছিলেন... অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন... তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি-এর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি-এর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রস সমিতি-এর আজীবন সদস্য ও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি-এর আজীবন সদস্য ছিলেন... এছাড়াও বাংলাদেশ মহিলা সমিতি-এর আজীবন সভানেত্রী এবং কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বোর্ড অফ গভর্নরসের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন... তিনি ইন্টারন্যাশনাল এলায়েন্স অফ উইমেন-এর সভানেত্রী এবং এসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অফ দি ওয়ার্লাল্ড-এর সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়া-এর এরিয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র নেতৃবৃন্দকে সংগঠিত করার কাজে তিনি ঐকান্তিকভাবে কাজ করে গেছেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি বিএলএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

অর্থ ও উপকরণ সংগ্রহ, প্রচারপত্র বিলি, তরুণ-তরুণীদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো ইত্যাদির সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য তাঁকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করেন এবং সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান তাঁকে দোষারোপ করে কঠোর ভাষায় সতর্কপত্র দেন । সতর্কপত্রটি জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কুখ্যাত আলবদর ও আলশামস্ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকান্ড ড. নীলিমা ইব্রাহিম-এর মনে প্রচন্ড আঘাত হানে। তাঁদের আত্মত্যাগকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের পর ড. নীলিমা ইব্রাহিম দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বহু বীরাঙ্গনাকে তাঁদেরই ত্যাগে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগান। তিনি নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং নিজ উদ্যোগে বহু অসহায় বীরাঙ্গনাকে সমাজে সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের অবদানকে চিরস্মরণীয় করতে রচনা করেন কালজয়ী গ্রন্থ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। এই মহীয়সী নারী ২০০২ সালের ১৮ জুন ঢাকায় নিজ বাস-ভবনে মৃত্যু বরণ করেন। তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। গবেষণাঃ শরৎ প্রতিভা (১৯৬০), বাংলার কবি মধুসূদন (১৯৬১), উনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালী সমাজ ও বাংলা নাটক (১৯৬৪) নাটক- উৎস ও ধারা (১৯৭২), বেগম রোকেয়া (১৯৭৪) বাঙ্গালী মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৮৭), সাহিত্য সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১) ছোটগল্পঃ রমনা পার্কে (১৯৬৪) উপন্যাসঃ বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিনী (১৯৬২), বহ্নিবলয় (১৯৮৫) নাটকঃ দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকাল (১৯৭৪) কথা নাট্যঃ আমি বীরঙ্গনা বলছি (২ খন্ড, ১৯৯৬-৯৭) অনুবাদঃ এলিনর রুজভেল্ট (১৯৪৫), কথাশিল্পী জেম্স ফেনিমোর কুপার (১৯৬৮) ভ্রমনকাহিনীঃ বস্টনের পথে (১৯৮৯), শাহী এলাকার পথে পথে (১৯৬৩) আত্মজীবনীঃ বিন্দু বিসর্গ (১৯৯১)৷ স্বীকৃতি ও সম্মণনাঃ তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বহু পদক ও পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধূরী স্মৃতিপদক (১৯৯০), মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯২), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মননা পদক (১৯৯৭), একুশে পদক (২০০০), স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) (২০১১)।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন