একুশ মানে মাথা নত নয়, চেতনায় আগুয়ান

  21-02-2017 11:46AM



পিএনএস: একুশে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের জনগণের জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এই একুশে ফেব্রুয়ারী। মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দিন এটি। এর পিছনে রয়েছে এক মর্মন্তুদ ইতিহাস। পাকিস্থান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। ১১ শ্রাবণ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। আর তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ-ভাগ হয়। আমরা পূর্ব-পাকিস্তান নামে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকি। সেই পাকিস্তানের মোট জনগণের প্রায় ৫৬% লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা আর মাত্র ০৪% লোকের মুখের ভাষা ছিল উর্দু। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্ত চলতে থাকে। ওদিকে পূর্ব পাকিস্থানও ধীরে ধীরে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপক কর্তৃক গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন “তমদ্দুন মজলিশ” প্রথম প্রতিবাদ করে। এতে পশ্চিম পাকিস্তান না থামিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শাসন-শোষণ ও ভাষা সংত্রান্ত সিদ্ধান্ত চালিয়ে যেতে থাকে। তারপরও রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গঠিত হয় “স্টুডেন্ট’স অ্যাকশন কমিটি”। এভাবেই তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এ দেশের জনগণ সোচ্চার ছিল।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্থান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্থানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানিন্তন পাকিস্থানের প্রথম গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় ঘোষণা দেন "Urdu only, and Urdu shall be the state language of pakisthan."তার এ বক্তব্যের সাথে সাথে ময়দানেই এর প্রতিবাদ হয়। এর তিনদিন পর ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে “স্টুডেন্ট’স রোল ইন নেশন বিল্ডিং” শিরোনামে একটি ভাষণ দেন এবং সেখানেও তিনি একই কথা অথার্ৎ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। আর তখন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কর্ণপাত করেন নি। কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণ তাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে থাকে এবং পরবর্তীকালে গোটা দেশবাসী এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে ছাত্রসমাজের মনোবল আরো বেড়ে যায় এবং তারা দিগুন উৎসাহে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সম্মুখে এগিয়ে যায়। ১৯৫১ সালে "The Dhaka University State Language Movement Committee" গঠিত হয় এবং রাষ্ট্রভাষা রাংলার দাবি জানাতে থাকে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে সমাবেশ স্থলেই ছাত্রসমাজ তুমুল উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ২৮ জানুয়ারি বিক্ষোভ করে এবং ৩০ জানুয়ারী সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের নিয়ে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে। এর পরিপেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু দেখা যায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে সমাবেশ স্থলে ছাত্র-ছাত্রীরা জমায়েত হয়-এতে হাজার হাজার জনতাও স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নেয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অর্ন্তগত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। এ সময় পুলিশ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মার্স্টাস এর ছাত্র আবুল বরকতসহ রফিক উদ্দিন, আব্দুর জব্বার নামে তিন তরুণ শহীদ হন এবং অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হতাহত হন। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আব্দুস সালাম হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়া শফিক, কিশোর অহিউল্লাহও শহীদ হন। এরপর বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারী সেইসব শহীদ ভাইদের স্মরণে ১৯৫৩ সালে শহীদ মিনার স্থাপন করে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। আর ২১ ফেব্রুয়ারীর এই চেতনার ফলেই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট বিজয় লাভ করে। ফলে যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে ১৯৫৪ সালে ০৭ মে পাকিস্থান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সালে ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৫৬ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় সংসদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাশ করে এবং ০৩ মার্চ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা কার্যকর হয়।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে “তমদ্দুন মজলিস” এর মাধ্যমে মায়ের ভাষার কথা বলার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা অর্জিত হয়ে আজ ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারী বিশ্বের ১৮৮টি দেশে পালিত হয়। মায়ের মুখের ভাষার সতীত্ব রক্ষায় বাংলার নির্মম-মৃত্যু-ভয় নির্লিপ্ত দুর্জয় সন্তানেরা নিজ বুকের রক্ত পিচ ঢালা কালো রাস্তাকে রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই ২১ ফেব্রুয়ারী বা ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্দমনীয় সংকল্পের গভীরে প্রোথিত শেকড়ে রস সঞ্চার করেছে এবং দেশকে তার কাঙ্খিত গন্তব্যে নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশ কি আজ সেই কাঙ্খিত গন্তব্যে আছে। বুদ্ধিদীপ্ত উদীয়মান ছাত্রসমাজসহ আপামর জনগণ দেশে চলমান আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকসহ সর্বময় অধিকারের বিষয় নিয়ে আজ একটু ভাবুন তো।
সুস্থির, নিরাপত্তা, অধিকার সম্বলিত জীবন যাপন ও টেকশই উন্নয়নের জন্য একুশের চেতনা বুকে ধারন করে এগিয়ে যেতে হবে। যার মুলমন্ত্র হোক “একুশ মানে মাথা নত নয়-চেতনায় আগুয়ান”।
লেখক: মোঃ মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন