আজ, সেই ভয়াল ২৫ শে মার্চ-কালো রাত

  25-03-2017 01:27AM

পিএনএস ডেস্ক (মোঃ মিজানুর রহমান): আজ, সেই ভয়াল ২৫ শে মার্চ-কালো রাত। ১৯৭১ সালের এই দিনে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদের ষড়যন্ত্রমূলক মনোবৃত্তি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আমাদের উপর চালায় অমানবিক, নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড--যা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই ২৫ শে মার্চে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ একদিনে আসে নাই। দেশ ভাগের পর থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানীদের শোষণ, বঞ্চনা করতে থাকে এবং সেই সাথে ষড়যন্ত্রের জালও বিছাতে থাকে। তাদের শাসন বা দমননীতির স্বরূপ আসে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। এর প্রতিবাদে আমাদের ১৯৬৬ এর ৬দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আসে। কিন্তু তাতেও মুক্তি মিলে না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের দমননীতি শাসন ও ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে। পূর্ব পাকিস্তানেও প্রতিবাদে আন্দোলন চলতে থাকে। এর ফলে পুরো দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলাহীন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল ২৫ শে মার্চের ঠিক দুই বছর আগে ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ আইয়ুব খান কমান্ডের-ইন-চিফ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পর ইয়াহিয়া খানও পুরো দেশে সামরিক শাসন জারি করেন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদ ভেঙ্গে দেন। অতঃপর ৩১ শে মার্চ তিনি রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণ করেন এবং Legal frame work order বা আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা করেন। Legal frame work order বা আইনগত কাঠামো আদেশ ছিল তাদের (পশ্চিম পাকিস্তানীদের) স্বার্থ সিদ্ধির মোটামুটি একটা দলিল। শেখ মুজিবুর রহমান সেই দলিলে স্বাক্ষর করে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। কিন্তু Legal frame work order পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থসিদ্ধির হওয়ায় মওলানা ভাসানীর ন্যাপ, আতাউর রহমান এর জাতীয় পার্চিসহ অন্যান্য দল স্বাক্ষরও করেন নি, নির্বাচনে অংশও নেন নি। ১৯৭০ এর সেই নির্বাচনে শেখ মুজিব নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ মহিলা আসনসহ ১৬৭ আসনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। কিন্তু ক্ষমতা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের গড়িমসি অব্যবহিত থাকে।

ভুট্টো-ইয়াহিয়া ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ করেন। ১৫ ই ফেব্রুয়ারী অধিবেশন বসার কথা থাকলেও তা বাতিল করে ০৩ মার্চ নির্ধারন করেন। পরে ২৮ শে ফেব্রুয়ারী ভুট্টো সাহেবের এক জনসভা থেকে ০৩ রা মার্চ অধিবেশন স্থগিত রাখার আহবানে সাড়া দিয়ে ইয়াহিয়া খান ০১লা মার্চ দুপুরের এক বেতার ভাষণে ০৩ রা মার্চের অধিবেশনও স্থগিত ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমার এর প্রতিবাদে জনতার উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ০২রা ও ০৩রা মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাত্মক সাধারণ হরতাল পালনের আহবান জানান।

০২রা মার্চ হরতাল পালনকালে বুলেটের আঘাতে ২জন শাহাদৎ বরণ করলে প্রতিবাদে ০৩রা মার্চ থেকে ০৬ মার্চ ভোর পর্যন্ত প্রদেশব্যাপি ধর্মঘট ডাকেন। ০৩রা মার্চ জাতীয় শোক দিবস ছিল এবং ০৩রা মার্চ ছাত্রলীগ এবং জাতীয় শ্রমিকলীগ আয়োজিত জনসভা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান মিছিলে যান না বরং ০৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা ঘোষণা করেন। মিছিলে না যাওয়ার কারনে ছাত্র ও যুব নেতারা শেখ মুজিবের ভূমিকাকে দুর্বল মনে করেন এবং তারা আলাদা ধারায় চলতে শুরু করে। এরপর থেকে শেখ মুজিব তার ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ীতেই বেশী বসেন এবং সেখান থেকেই তার সিদ্ধান্ত হয়। ০৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে ২৫ শে মার্চ আবার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহবানের ঘোষণা দেন।

অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমান ০৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি দেন-যার উল্লেখযোগ্য উক্তি ‘.........এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’.............। আবার শেষে ‘জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান’ও বলেছিলেন- যা পশ্চিম পাকিস্থানীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ স্বরূপ।। সেই ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানে সব কিছু বন্ধ করার আহবান জানান (কিছু অফিস-আদালত শিথিল ছিল।)

মওলানা ভাসানী ০৯ মার্চ পল্টন ময়দানের ভাষনে বলেন, ‘‘কোন শক্তিই এখন বাংলার পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে বাঁচার অধিকারকে নস্যাত করতে পারবে না।’’

......এভাবে চলতে চলতে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক শাসন কর্তা জেনারেল টিক্কা খান ১৩ মার্চ তারিখে এক আদেশ বলে সামরিক বিভাগে কর্মরত বেসামরিক কর্মচারীদের ১৫ মার্চ যথারীতি কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেন।

এদিকে সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন। এটা ছিল বাহিরের দৃশ্য কিন্ত ভিতরে ভিতরে তারা অন্য দৃশ্যপট সাজায় যার পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ পায় ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর মাধ্যমে।

তারপর ১৫ মার্চ, ১৬ মার্চ, ১৭ মার্চ, ১৮ মার্চ, ১৯ মার্চ, ২০ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক চলে। কিন্তু কোন সমাধান হয় না। শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসার বিষয়ে কোন ছাড় দেন না। ওদিকে ভুট্টো সাহেবও ক্ষমতা নেওয়ার বিষয়ে তোড়জোড় করেন এবং ২১ মার্চ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলসহ ঢাকায় আগমন করেন।

২২ শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো’র গুরুত্বপূর্ন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। সে দিন সরকারী ও বেসরকারী ভবনগুলোতে পাকিস্থানের পতাকা উড়ার কথা ছিল। কিন্তু একমাত্র সামরিক সদর দপ্তর ও প্রেসিডেন্ট ভবন ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়ে নি। এছাড়া নানা অনুষ্ঠান হবার কথা। কিন্তু তার কিছুই হয় নি।

এলো ২৪ শে মার্চ, ইয়াহিয়া-শেখ মুজিবের মধ্যে বৈঠক হলো কিন্তু এতেও কোন সমাধান হলো না। শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়ে কোন ছাড় দিলেন না। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটল। ভুট্টো বাদে পিপল্স পার্টির সব নেতা এদিন ঢাকা ত্যাগ করলেন -কোন একটা পরিকল্পনা যেন কার্যকর হতে যাচ্ছে-এটা তারই লক্ষন বলে মনে হচ্ছিল। ওদিকে আরো আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদেরকে দাবিয়ে রাখার জন্য প্রচুর যুদ্ধের রসদ আনতে থাকল। একমাত্র অস্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (চট্টগ্রাম) ছাড়া সেনাবাহিনীর সব সেক্টরে অস্ত্র সরবরাহ করলো। কেননা, অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল বাঙ্গালী রেজিমেন্ট, তা ট্রান্সফরের প্রস্তুতি চলছিল-যেখানে ছিলেন ‘মুষ্ঠিযুদ্ধ’-এর বিজয়ী ও ভারতের বিরুদ্ধে ‘কারগিল যুদ্ধ’এর বিজয়ী সেনা মেজর জিয়াউর রহমান। ঢাকায় সৃষ্ট অসমাধান পরিস্থিতি ও পাকিস্তানের গোপনে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ কিছু একটা যে হতে যাচ্ছে-তা ভাবিয়ে তুলছিল অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সেনা মেজর জিয়াউর রহমানকে।

এলো ২৫ মার্চ ১৯৭১। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক রক্ত ঝড়া আধার সময়। এই ২৫ শে মার্চ সকালেই জেনারেল হামিদ, ওমার, মিঠা, পীরজাদা ও টিক্কা খান ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠক বসলেন-যা স্থায়ী ছিল ৩০ মিনিট। বৈঠকের ফল হলো এই, ইয়াহিয়া-শেখ মুজিবের উপদেষ্টাদের শাসনতান্ত্রিক আলোচনার (১৯, ২৩ ও ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া-শেখ মুজিবের উপদেষ্টাদের বৈঠক ) যে রেজাল্ট আওয়ামীলীগকে জানানোর কথা ছিল তা আর কোনদিনই জানানো হলো না। ২৫ শে মার্চ বিকেলে শেখ মুজিব ক্যান্টনমেন্ট সোর্সে জানতে পারলেন যে রাজনৈতিক সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই এবং সেনাবাহিনী তার অভিযানের জন্য তৈরি হচ্ছে। বিকেলে ঐ একই উৎস থেকে শেখ মুজিবকে বলা হলো, ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করছেন। এরপর বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে আওয়ামীলীগের উপরের সারির নেতারা ৩২ নং এ শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন, আলাপ করেন এবং চলে যান।

সন্ধ্যা ০৬ টায় পাকিস্তানী সাংবাদিক তারিক আলীর পিতা মাজহার আলী ও রেহমান সোবহান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন এবং তাকে জানান মিলিটারী ক্র্যাকডাউন আসন্ন। (সুত্র: বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এবং একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, রেহমান সোবহান, ভোরের কাগজ প্রকাশনী,১৯৯৪)।

এমনি অবস্থায় .... শেখ ফজলুল হক মনি ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায় টুংগী পাড়ায় চলে যান এবং শেখ কামাল রাত ৯ টায় ধানমন্ডি ৩২ নং ছেড়ে চলে যান।(সুত্র: শেখ মুজিব, এস, এ করিম, ইউপিএল,২০০৫, পৃষ্টা নং ১৯৫)।

ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে ঝন্টু (জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা জাকারিয়া চৌধুরীর ভাই) ধানম-ি ৩২ নং এ আসেন। শেখ মুজিবকে ঝন্টু অপারেশন সার্চ লাইট এবং নির্বিচার গোলাগুলির খবর জানান। ঝন্টুর মাধ্যমে পরিস্থিতি অবগত হয়ে শেখ মুজিব হাসিনা, রেহেনা, এবং জেলীকে একটি ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেন আত্মগোপন করার জন্য। শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের আত্মগোপন করার জন্য ঐ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। ওয়াজেদ মিয়া নিজেও ১১:৩০ মিনিট এর পর ধানমন্ডি ৩২ নং ত্যাগ করেন। (সুত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলদেশ, ইউপিএল,২০০০,পৃষ্টা-৮৪)।

শেখ মুজিবের সাথে সে দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক নেতারা দেখা করতে এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগকে তিনি সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আত্মগোপন বা লুকিয়ে থাকতে বলেছিলেন। এমন সময় জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ শেখ মুজিবের সাথে ৩২নং এ দেখা করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বলেন- এ সর্ম্পকে এখানে উল্লেখ-[২৫ মার্চ যখন স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানী হানাদাররা আক্রমন চালায় তখনও স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানান সে সময়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’, ‘তাজউদ্দিন আহমদ : নেতা ও পিতা’ কিংবা আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক একে খন্দকারের লেখা “৭১ ঃ ভেতরে-বাইরে”সহ বাংলদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইতে এর প্রমাণ রয়েছে। এতে দেখা যায়, আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম তাজউদ্দিন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার আহবান জানালেও শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি, এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানান। শুধু অস্বীকৃতিই নয় তিনি তাজউদ্দিনকে পরামর্শ দিয়ে বলেন “যাও নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও আমি ২৭ মার্চ হরতাল ডেকে দিয়েছি।” আর পাকিস্তানীরা যাতে তাকে দেশদ্রোহী বলতে না পারে এজন্য শেখ মুজিব পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। (সুত্র:‘তারেক রহমান এবং বাংলাদেশ’-আব্দুল হাই শিকদার)]।
শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন না-কি আত্মসমর্পন করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। সে যাই-হোক, শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার ঘোষণা সে সময় দেননি, উপরের উদাহরণে তা বুঝা যায়।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা একদিকে শেখ মুজিবকে ঐ রাতেই পাকিস্থানে নিয়ে যায়, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানীদের অর্থাৎ আমাদের উপর চালায় নিকৃষ্টতম, জঘন্য, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। যার নাম ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। এশিয়া টাউমসের ভাষ্য মতে-সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, “তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।” সে পরিকল্পনা অনুসারেই ২৫ শে মার্চের সেই ভয়াল কালো রাত্রিতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদাররা স্টেনগান, বোমা, বুলেট ইত্যাদি চালিয়ে অমানবিকভাবে হত্যা করল এদেশের অগণিত ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ লোকজনদেরকেও। সে রাতে শুধু চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ আর ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের আতœচিৎকার। সে আত্মচিৎকারে ঢাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। ঢাকার রাস্তা সেদিন লাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেই ভয়াল রাতে সে এক হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী ঘটনা।

এ বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষে ২৫ শে মার্চের আগেই বিদেশী সাংবাদিকদের ঢাকা পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। কিন্তু সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় থেকে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন।

আমাদেরকে মেধাশুন্য করার জন্য সেই ২৫ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও ছাত্রদের, শিক্ষকদের হত্যা করা হয়, হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। তাদের এ জঘন্য, নিষ্ঠুর, অমানবিক হত্যাকা- থেকে সে দিন রক্ষা পায় নি ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সাধারন খেটে খাওয়া মানুষগুলোও। এ হত্যার দায় কি তৎকালীন রাজনীতিবিদদের উপর বর্তায় না ? তৎকালীন রাজনীতিবিদরা কি এর জন্য দায়ী না ?

২৫ শে মার্চের সেই কালো রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল ঢাকা শহর, বৃষ্টির মত নির্মম গুলির বর্ষণে নিরীহ মানুষগুলোর নিথর দেহ পড়েছিল ঢাকার অলি-গলি-রাস্তাঘাটে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ সে সময় পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর বোমা আর গুলির বেষ্টনে যেন আবদ্ধ। প্রতিরোধের কোন চিহ্ন যেন নেই। কি করবে কোন দিকে যাবে কোন নির্দেশনা নেই। জাতির সামনে চারদিকে যেন শুধুই আধার। জাতি যেন দিশাহারা। দেশের এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যেন ঘুরে দাড়াল। সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমিক সেনাদের সংগঠিত করলেন এবং নিজ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন “উই রিভোল্ট........./ We Revolt....... ” এবং স্বাধীনতার ঘোষণাও দিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান যে ‘রিভোল্ট’ ঘোষণা করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এ সর্ম্পকে মুক্তিযুদ্ধের ০৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ বীরউত্তম তার [Bangladesh at War, Academic Publishers, Dhaka, 1994] বইতে লিখেছেন, “মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্থানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সবাইকে আহবান জানান।

এ ঘোষণার সাথে সাথে যেন সেই ভয়াল ২৫ শে মার্চ-কালো রাত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর মধ্যে থেকে আমরা মানে জাতি বিভীষিকাময় আধার পরিস্থিতি থেকে আলোর দেখা পেল। সে ঘোষণা শুনে তরুণ-বৃদ্ধ-যুবক-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-নর-নারী তথা আপামর জনসাধারণ;যে যার অবস্থান থেকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ.............................।
লেখকঃ মোঃ মিজানুর রহমান-সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন