শর্ত-শাস্তি নিয়ে রুষ্ট পরিবহন নেতারা

  23-04-2017 08:26AM


পিএনএস ডেস্ক: প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় চালকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত জুড়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন অপরাধে কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখায় পরিবহন খাতের নেতারা রুষ্ট সরকারের ওপর। খসড়া আইনটি সংসদে উত্থাপিত হওয়ার আগেই এসব বিধান বাতিল বা সংশোধন করতে সরকারকে রাজি করানোর লক্ষ্যেই আন্দোলনে নামছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। রাজধানীসহ দেশজুড়ে তাদের তিন মাসের আন্দোলন শুরু হচ্ছে আজ রবিবার। গত সপ্তাহে ঢাকায় হঠাৎ সিটিং সার্ভিসবিরোধী অভিযান উসকে দিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার পর উদ্যোগী পরিবহন নেতারা পিছু হটেন। অভিযানে নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে এলে ওই অভিযান স্থগিত করা হয়।

সরকারকে চাপে ফেলতে চলতি মাসের শুরুতেই আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবহন শ্রমিকরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে আজ দুপুরে। আগামী বুধবার ঢাকায় হবে মালিক-শ্রমিক সমাবেশ।

এর আগেও সড়ক দুর্ঘটনার দায়ে কঠিন শাস্তির প্রস্তাব রাখা এমনকি ট্রাকচাপা দিয়ে মানুষ হত্যার অপরাধে ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে গিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকরা। জানা গেছে, প্রস্তাবিত আইনের যেসব ধারা পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের পছন্দ নয় সেগুলো তারা আন্দোলনের মাধ্যমে বাতিল বা সংশোধন করাতে চাইছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, এ দেশের পরিবহন শ্রমিকরা আগুন-সন্ত্রাসের সময় প্রাণ দিয়েছে, আহত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জুলুম হতে পারে না।

পরিবহন নেতারা দাবি করছেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি দুদু বলেন, ‘২৩ এপ্রিল সারা দেশে মানববন্ধন, জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হবে। স্মারকলিপিতে আমরা প্রস্তাবিত আইনে অস্বাভাবিক জরিমানা না রাখার সুপারিশ করব। আগে যেখানে জরিমানা ৫০০ টাকা ছিল তা পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা করা হয়েছে। নতুন আইন অনুমোদন হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এ জরিমানা আদায় করা হবে। জরিমানা দিতে হবে মালিকদের, জেল হবে আমাদের শ্রমিকদের। এ জন্যই আমরা কর্মসূচি পালন করব যৌথভাবে। ২৬ এপ্রিল মহানগর নাট্যমঞ্চে মালিক-শ্রমিক সমাবেশে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে। তারপর দেখা যাবে আমরা কী করতে পারব। ’

ছয় বছর ধরে যাছাই-বাছাইয়ের পর সরকার সড়কে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ আনতে এই নতুন আইন করতে যাচ্ছে। গত ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভা ওই আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। এটি মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান বাদ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া। এতে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী বিচার ও শাস্তি হবে। তবে বেশ কিছু অপরাধে কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

আইনের খসড়ায় ১৩টি অধ্যায় ও ৭২টি ধারা রয়েছে। অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কিত তফসিলও সঙ্গে রয়েছে। সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে প্রণীত মোটর যান অধ্যাদেশে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো শর্ত নেই। নতুন আইনের খসড়ায় গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে প্রার্থীকে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি রাস্তায় গাড়ি চালাতেও পারবে না। ১৮ বছরের কম বয়সী কেউ লাইসেন্স পাবে না। ভারী যানবাহনের বৈধ চালক হতে প্রার্থীর বয়স ২১ বছর হতে হবে। গাড়িচালকের পাশাপাশি কন্ডাক্টরদেরও লাইসেন্স নিতে হবে। কন্ডাক্টরদের হতে হবে কমপক্ষে পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ। ‘ওস্তাদের’ কাছে গাড়ি চালানো শিখে লাইসেন্স ছাড়াই দেশে লাখ লাখ ব্যক্তি চালক বনে গেছে। কিশোররাও মহাসড়কে ভারী গাড়ি চালাচ্ছে। তাদের বেপরোয়া চালনায় সড়কে প্রতিদিন যাত্রী, পথচারী, এমনকি পরিবহন শ্রমিকেরও প্রাণ যাচ্ছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত চালক বানাতে অনাগ্রহী। এ ছাড়া নতুন শর্ত বাস্তবায়িত হলে নিরক্ষর চালকদের লাইসেন্স বাতিলের ঝুঁকি রয়েছে। ফলে তাদের বহুদিনের ‘রাজনীতি’ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

নতুন আইনের খসড়ায় উন্নত দেশগুলোর মতো একেকটি লাইসেন্সের বিপরীতে রাখা হয়েছে ১২ পয়েন্ট। বিভিন্ন অপরাধে এসব পয়েন্ট কাটার সুপারিশ রয়েছে। অর্ধেক পয়েন্ট কাটা হলে পুরো বছরের জন্য লাইসেন্স স্থগিত করা হবে। সব পয়েন্ট কাটা হলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। এক বছর পর লাইসেন্সের জন্য আবার আবেদন করা যাবে। তবে তিনবার লাইসেন্সের সব পয়েন্ট কাটা পড়লে চালক গাড়ি চালানোর যোগ্যতা হারাবে।

খসড়া অনুসারে, ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালালে দুই বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। লাইসেন্সধারী চালকের অপরাধের ক্ষেত্রে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের সঙ্গে দোষসূচক পয়েন্ট কাটার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। চালকের সহকারীর লাইসেন্স থাকতে হবে। তা না থাকলে তাকে এক মাসের কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

খসড়া আইনে বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সংরক্ষিত আসনে কেউ বসলে বা তাদের না বসতে দিলে এক মাসের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

গাড়ি ও যাত্রীর বীমা বাধ্যতামূলক করে এটি ছাড়া গাড়ি চালালে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। বীমাহীন গাড়িতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন পরিবহন মালিক। না হলে মালিকের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে। মদ্যপ অবস্থায় কেউ গাড়ি চালালে তিন মাসের কারাদণ্ড ও ৩৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় কানে মোবাইল ফোন, ইয়ারপ্লাগ বা এ ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করলে চালকের এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে এমন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চালকদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। একই অপরাধ দুইবার সংঘটিত হলে দ্বিগুণ দণ্ড ভোগ করার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া আইনে।

এ ধরনের বিধান রাখা হলে রাস্তায় চালকরা কিভাবে গাড়ি চালাবে সে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক পরিবহন শ্রমিক নেতা।

খসড়া আইনে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে তিন মাসের কারাদণ্ড ও ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং চালক ও আরোহী হেলমেট ছাড়া কিংবা উল্টো পথে চালালেও একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সিটবেল্ট না বেঁধে গাড়ি চালালেও শাস্তি হবে। চালক বা সহযোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে যাত্রীদেরও শাস্তি পেতে হবে।

ভারতের ১৯৩৯ সালের মোটরযান আইনের আদলে ১৯৮৩ সালে মোটরযান অধ্যাদেশ করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে এর বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হলেও সেটি হালনাগাদ করা হয়নি তিন দশকেরও বেশি সময়ে। এই সময়ের মধ্যে সড়ক ও গাড়ি বেড়েছে। সেই সঙ্গে নতুন প্রযুক্তিও এসেছে। পুরনো আইনে অপরাধীর শাস্তি কম থাকাসহ নানা অসংগতিতে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের আওতায় সড়ক পরিবহন আইন আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালে সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইন বিষয়ে খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।

প্রস্তাবিত আইনের একটি অংশ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আইন গত বছর চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী বাজেট অধিবেশনে তা অনুমোদন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রস্তাবিত আইনের দ্বিতীয় অংশের ওপর যাছাই-বাছাই শেষে তৈরি হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭। এর আগে ২০১৪ সালে আইনটির খসড়া তৈরির পর বিভিন্ন পর্যায়ে মতামত নেওয়া হয়।

খসড়া অনুসারে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালালে এক বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রকৃতপক্ষে ফিটনেসহীন গাড়ি আছে প্রায় সোয়া দুই লাখ। এ বিধান রাখায় এসব গাড়ির মালিকরা নাখোশ।

সড়কে দুটি গাড়ি পাল্লা দিয়ে চালানোর সময় সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। নগরী বা মহাসড়কে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর দৃশ্য নিত্যদিনের। যাত্রী বেশি নিয়ে বেশি ট্রিপ দিতে মালিকরাই চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালাতে চাপে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আগামী বুধবার জেলায় জেলায় মালিক-শ্রমিক সমাবেশ করা হবে। ১ মে সারা দেশে যান চলাচল বন্ধ রাখা হবে এবং সমাবেশ করবে শ্রমিকরা। ২ মে সব জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। ৭ থেকে ১৩ মে সব সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন শ্রমিক নেতারা। জানা গেছে, এর পরও আইন সংশোধন না হলে দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডাকারও পরিকল্পনা রয়েছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন