বিবিসির বিশ্লেষণ : বাংলাদেশে গুম-অপহরণ নিয়ে কেন এই আতঙ্ক-উদ্বেগ?

  28-04-2017 10:36AM



পিএনএস ডেস্ক: বাংলাদেশে তিন বছর আগে ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে শহরের কাউন্সিলর ও আইনজীবীসহ মোট সাতজন নিখোঁজ হয়েছিলেন। র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

তিন বছর আগের ওই ঘটনায় জড়িত র্যাব কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের সাজা হলেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ এবং গুমের ঘটনা কমছে না।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি গত ২২ মার্চ বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি এবং সেগুলোর তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গত তিন বছরে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর ২৬৭ জন নিঁখোজ হয়েছেন।

২০১৫ সালে এই সংখ্যা ৫৫ জন ছিল এবং ২০১৬ সালে সেটি বেড়ে ৯৭ জনে দাঁড়ায়। আর ২০১৭ সালের তিন মাসে গুমের ঘটনা ঘটে ২৫টি, যার মধ্যে মার্চেই ১৪টি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গুম পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, এমনও অভিযোগ আসছে যে সরকারি বাহিনীর লোকজনরা সিভিল ড্রেসে বা কখনো ইউনিফর্মে কখনো অন্যের ভাড়া করা গাড়িতে বা নিজেদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে আসছে। এই যে যারা গুম হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেককে আবার ফেরতও পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, এটা মানবাধিকারের একটা চরম লঙ্ঘন। সেই কারণে মানবাধিকার কমিশনও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে এই জাতীয় ঘটনা কেন গ্র্যাজুয়ালি (ক্রমাগত) বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি সুইডিশ একটি রেডিওতে বাংলাদেশের একজন র্যাব কর্মকর্তার গোপন রেকর্ড প্রকাশ করেছে যেখানে কী কায়দায় ধরে নিয়ে গুম করা হয় সেটি উঠে এসেছে। তবে র্যাব জানায় এটি ভিত্তিহীন এবং রেকর্ডটি ভুয়া।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার দায়িত্বে থাকা কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, প্রতিটি অভিযোগেরই সুষ্ঠু তদন্ত হয় এটা আমরা নিশ্চিত করি। র্যাব সদস্য বলে কোনো অন্যায় অপরাধ করলে পার পেয়ে যাবে এমন কোনো নজির নাই।

খান বলেন, আমরা বলতে চাই যে এ পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ পাওয়া গেছে, সত্যতা পাওয়া গেছে তাদেরকে শাস্তি পেতে হয়েছে। এখানে কখনো কাউকে ছাড় দেওয়া হয় নাই। ভবিষ্যতেও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

এছাড়া তাদের অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর ভুয়া পরিচয় দিয়ে এরকম অপরাধে জড়িত বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান ওই র্যাব কর্মকর্তা।

বাংলাদেশে গুমের শিকার পরিবারগুলোর গুরুতর অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধেও। যেমন সাতক্ষীরা জেলার জেসমিন নাহারের অভিযোগ পুলিশ আটক করার চার দিন পর থেকে তার স্বামী মোখলেসুর রহমান নিখোঁজ।

তিনি বলছিলেন, আমার স্বামী ডাক্তার শেখ মোখলেসুর রহমান জনি ২০১৬ সালে ৪ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা সদর নিউ মার্কেটে ওষুধ কিনতে যায়। ওইদিন রাতে একটার দিকে অনেকগুলো পুলিশ আমাদের বাড়িতে পুলিশ সার্চ করতে যায়। সার্চ করতে যাওয়ায় আমরা সন্দেহ করি যে আমার স্বামীর ফোন নম্বর বন্ধ পাচ্ছি, তাহলে সে কোথায়!

জেসমিন বলেন, ৫ তারিখে আমরা বিভিন্ন জাগায় খুঁজে না পেয়ে গিয়ে থানা হাজতে দেখতে পাই। ৫,৬,৭ এই তিনদিন আমি আমার স্বামীকে থানায় যেয়ে খাবার দিয়েছি এবং দেখা করছি। আট তারিখে যখন আমি সকালে খাবার নিয়ে যাই তখন আমাকে বলা হয় আমার স্বামী ওখানে নাই। বলে কোথায় আছে জানি না।

জেসমিনের অভিযোগ পুলিশ আটকের পর তার স্বামী নিঁখোজ হয়েছেন মর্মে থানায় জিডি করতে চাইলে সেটি নেয়া হয়নি। মানবাধিকার সংস্থার সহায়তায় জেসমিনের অভিযোগ উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে গত ১৩ এপ্রিল পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে একটি প্রতিবেদন দিয়ে বলা হয়েছে, মোখলেসুর রহমানকে সাতক্ষীরা থানার পুলিশ আটক করেনি।

বাংলাদেশে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষকসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষই গুমের শিকার হয়েছে।

গুম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের এআইজি সহেলি ফেরদৌস বলেন, তদন্ত করে দেখা যাচ্ছে ভুয়া পরিচয়ে এরকম অপহরণ করা হচ্ছে।

তার কথায়, যখন কোনো অভিযোগ আসছে যে এরকম তুলে নিয়ে গেছে পুলিশের পরিচয়ে এবং থানার কাছে যখন আসে অবশ্যই ব্যাপারটিকে আমরা ভেরিফাই করি যে ঘটনা সত্যি ছিল কিনা, পুলিশের ইনভলমেন্ট ছিল কিনা অথবা পুলিশ পরিচয়ে কেউ কিছু করছে কিনা।

তিনি বলেন, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে যে পুলিশ জড়িত, সেটা নয়। পাবলিক যখন এই অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন তারা কিন্তু হয় পুলিশ, না-হয় বা র্যাবের নামে মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউনিফরমে অপহরণের থেকে বেশি সমস্যা হচ্ছে সাদা পোশাকে ডিবি পরিচয়ে।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে গুমের আতঙ্ক মানুষের মধ্যে ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করেছে। অনেকের মতে বিনা পরোয়ানায় আটকের ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো।

ব্লাস্ট এর নির্বাহী পরিচালক ব্যরিস্টার সারা হোসেন বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় এমনো কথা রয়েছে যে একজনকে গ্রেপ্তার করার পরপরই তার স্বজনকে তার পরিবারের কাউকে অথবা তাদের কাউকে না পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তির চিহ্নিত করা তার কোনো বন্ধুকে জানাতে হবে যে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কোথায় রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, পাশাপাশি তাকে কখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে আর কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এগুলিও জানাতে হবে। আমার জানা মতে এ দিকনির্দেশনাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে না এবং গুম সম্পর্কিত আমরা যে তথ্য পাই সেই ক্ষেত্রে পালন করা হয়েছে তাতো মনে হয় না। পালন হলে তো গুম পর্যন্ত ঘটনাটা যেত না।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন