রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ২০ বিয়েবিচ্ছেদ

  27-07-2017 11:42AM

পিএনএস : প্রেম কিংবা পারিবারিকভাবে বিয়ে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সম্পর্কে ছেদ। পারস্পরিক বোঝাপড়া হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের বিচ্ছেদও শেষ পর্যন্ত তালাকে পরিণত হচ্ছে। দীর্ঘদিনের সাজানো সংসারও ভেঙে যাচ্ছে ‘তাসের ঘরের’ মতো। এমন ঘটনা বেড়েই চলেছে দেশে। তবে রাজধানীতে বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, প্রতিদিন গড়ে ২০টি বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। আর এ তালাকের ৭০ ভাগই হচ্ছে নারীদের পক্ষ থেকে।

সম্প্রতি তারকা দম্পতি তাহসান-মিথিলার বিচ্ছেদের ঘোষণা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। সমাজের সর্বস্তরে এ নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। কয়েক দিন আগে আরেক তারকা দম্পতি শখ ও নিলয়ের বিচ্ছেদের খবর শোনা যায়। এর আগে ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সালমা, কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ এবং কণ্ঠশিল্পী হৃদয় খান ও সুজানা দম্পতির বিয়েবিচ্ছেদ হয়েছে। তবে ভাঙনের শব্দ শুধু তারকাদের বেলাই নয়, সব ক্ষেত্রেই শোনা যায়। সেসব খবর আমজনতার কানে হয়ত পৌঁছে না, তবে ঘটনা কিন্তু ঘটে, ঘটছেই। কিন্তু কেন বাড়ছে এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা?

মনোবিজ্ঞানী, আইনবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সমস্যা আগেও ছিল। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ বিষয়গুলো বিবেচনা করে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করত। এখন সেই চিন্তা-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। ছোটখাটো ঘটনা গড়াচ্ছে তালাক পর্যন্ত এবং সহজেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দম্পতিরা। উন্নত দেশের মতো ঘোষণা দিয়ে বিয়েবিচ্ছেদের রেওয়াজও চালু হয়েছে দেশে।

তাদের মতে, সামাজিক অস্থিরতা, যৌতুক, নারী স্বাধীনতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, পরকীয়া, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে বিচ্ছেদ ঘটছে। এ ছাড়া পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে সম্মান না থাকাও বিয়েবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগীন বলেন, যৌতুক আমাদের মতো দেশের জন্য বিয়েবিচ্ছেদের বড় কারণ। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কও কম দায়ী নয়। বিয়ের পর একজন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাল মেলাতে পারে না। মোবাইল ফোন, ফেসবুক ব্যবহার থেকে সন্দেহও বড় কারণ হিসেবে দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন, মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যে কেউ, যে কোনো সময় পার করতে পারেন। কিন্তু অনেকের প্রবণতা হলো, মানসিকভাবে একটু অসুস্থ হলে, সঙ্গীর চিকিৎসা করানোর পরিবর্তে তাকে ছেড়ে যাচ্ছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিয়ে, তালাক রেজিস্ট্রির পরিসংখ্যানে বিচ্ছেদের হার দিন দিন বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনের সালিশি বোর্ডের তথ্য মতে, মোট তালাকের ৭০ দশমিক ৮৫ ভাগ হয়েছে নারীর পক্ষ থেকে। বাকি ২৯ দশমিক ১৫ ভাগ তালাক দেওয়া হয়েছে পুরুষের পক্ষে।

ওই তথ্য মতে, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে মোট তালাকের সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার। গত বছর এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ হাজার। ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৯ হাজার। ২০১৪ সালে ৮ হাজার ২১৫টি, ২০১৩ সালে ৮ হাজার ২১৪, ২০১২ সালে ৭ হাজার ৯৯৫, ২০১১ সালে ৫ হাজার ৩২২ এবং ২০১০ সালে বিয়েবিচ্ছেদ হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২০টির মতো বিচ্ছেদ হচ্ছে শুধু রাজধানীতেই। তবে এই চিত্র শুধু ঢাকা শহরেই নয়, সারা দেশেই বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদের সংখ্যা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিয়েবিচ্ছেদ করা অনেক সহজ। তাই এই সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে এই আইন সংশোধন করে কাউন্সিলিংয়ের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর মেহতাব খানম বলেন, বিয়েবিচ্ছেদ এখন পরিবারের কাছে খুব সহজ একটি বিষয় হয়ে উঠছে। আর এই বিচ্ছেদ এমনিতেই ঘটছে না। মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত হচ্ছে। তারা এখন অনেক সচেতন। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য না করে বিচ্ছেদের মতো একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এ ছাড়া মোবাইল কোম্পানিগুলোর নানা অফার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং পর্নোগ্রাফির মতো সহজলভ্য উপাদান থেকে আকৃষ্ট হয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা হারাচ্ছে মানুষ। ফলে প্রতিনিয়ত সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দিচ্ছে, যার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।

এ নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন ১৯৯৫ সাল থেকে গবেষণা করছে। প্রতিবছর বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়তে থাকায় ২০০৬ সালে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে অঞ্চলভিত্তিক সালিশ বোর্ড গঠন করে ঢাকা সিটি করপোরেশন।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জোন ৩-এর উপসচিব এসএম আনসারুজ্জামান বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়ে। উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব শ্রেণিপেশার মধ্য থেকেই আবেদন আসছে। তিনি বলেন, মোবাইল, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমোর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সহজলভ্য। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। এ ছাড়াও সামাজিক অসামঞ্জস্যসহ অনেক অভিনব কারণে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আধুনিকতার নামে পশ্চিমা ধাঁচের জীবনযাপন মানুষের জীবনের ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছে। এ কারণে মধ্য ও উচ্চবিত্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যায়। যার যার অবস্থান থেকে দ্রুত বড় হওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নীরব এক প্রতিযোগিতা কাজ করে। এ ছাড়া পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সম্মানবোধের অভাবের কারণে বেশিরভাগ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, সম্পর্কের ধরন বদলেছে। মানুষের বোঝাপড়ায় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের চাহিদা বেড়েছে। পক্ষান্তরে সহ্য ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। বিয়ের পর ফ্যামিলি বন্ডিং কমে যাচ্ছে।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন