বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, দুই দিনে ৫৮ জনের মৃত্যু

  15-08-2017 03:41PM

পিএনএস ডেস্ক : টানা বৃষ্টি ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতে তলিয়ে গেছে দেশের উত্তরাঞ্চলের ২০টি জেলা। গত দু’দিনে মারা গেছেন ৫৮ জন।

এর মধ্যে রবিবার ২৬ জন এবং সোমবার মারা যায় ৩২ জন। অন্যদিকে বন্যায় ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি নদী রক্ষার বাঁধ। পানির স্রোতের তীব্রতায় হুমকির মুখে পড়েছে তিস্তা ব্যারেজ এলাকা। সংশ্লিষ্ট এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। রেললাইন ও মহাসড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়াসহ মহাসড়কের কয়েক জায়গায় ভেঙে যাওয়ায় লালমনিরহাটের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। একই সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে উজানের ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও গঙ্গা অববাহিকা থেকে প্রচুর পানি ধেয়ে আসার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থা। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় (ইউএনআরসিও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ গবেষণাকেন্দ্র (জেআরসি) তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অঞ্চলগুলোতে গত শুক্রবার থেকে পানি বাড়ছে। আগামী ১৯শে আগস্ট পর্যন্ত এই পানি বাংলাদেশের ভাটির দিকে প্রবাহিত হবে। রিপোর্টে বলা হয় বিগত ১০০ বছরের মধ্যে তিব্বতের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় সবচেয়ে বেশি পানি বেড়েছে চলতি বছর। ৯৮ বছরের মধ্যে চলতি বছর সব চেয়ে বেশি পানি বেড়েছে তিস্তা অববাহিকায়। এবং ৭৫ বছরের মধ্যে চলতি বছর সব চেয়ে বেশি পানি বেড়েছে গঙ্গা অববাহিকায়।

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

দিনাজপুর : দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। জেলার সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শহর রক্ষাবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকা। সকাল পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে আরও চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আগের দিন মারা যান ৯ জন। জেলার বিভিন্ন সড়কে বাস-ট্রাকসহ বড় যান চলাচল করলেও অন্যান্য জেলার সঙ্গে দিনাজপুরের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

কুড়িগ্রাম : বৃষ্টিপাত থামলেও ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বন্যার পানিতে ডুবে আরও ৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রাজারহাটে তিস্তা-রমনা রেললাইনের ব্রিজের পিলার ভেঙে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার, নুন খাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার এবং পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমারের পানি বিপদসীমার ১৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় চার লাখ মানুষ। জেলার ৫৯১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ডুবে যাওয়ায় ৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে।

রংপুর : রংপুরে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় বানভাসি মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। রবিবার ভোরে গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টায় তিস্তার ডানতীর রক্ষাবাঁধের ৮০ মিটার এবং ছালাপাক উপ-বাঁধের ২০০ মিটার ভেঙে যাওয়া স্থান মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ড দিনরাত কাজ করছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ১ হাজার ৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা বাঁধ মেরামতে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।

জামালপুর : বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৬০ বছরের বন্যার রেকর্ড ভেঙে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, যমুনার পানি আরও বেড়ে বিপদসীমার ১৫০ ওপরে উঠে যেতে পারে। এদিকে যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদীগুলোর পানি বাড়ছে হু হু করে। ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ছাড়াও নতুন করে বন্যা প্লাবিত হয়েছে মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা।

সব মিলিয়ে জেলার ৫ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে মেলান্দহ-মাহমুদপুর, ইসলামপুরের আমতলী-শিংভাঙ্গা, আমতলী-উলিয়া বাজার, মলমগঞ্জ-জারুলতলা, ইসলামপুর-গুঠাইল সড়ক যোগাযোগ। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জেলার ২০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বগুড়া : সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সারিয়াকান্দি, ধুনট ও সোনাতলা উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। লোকজনের অনেকেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন বলছে, বন্যায় সাড়ে ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ময়মনসিংহ : সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ায় নিতাই নদীর বাঁধ ভেঙে ৫টি ইউনিয়নের ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। স্রোতে ভেসে গেছে কয়েকশ বাড়ি। নতুন করে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। মানবেতর জীবনযাপন করছেন বন্যার্তরা।

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা, অর্জুনা, গোবিন্দাসী ও নিকরাইল ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম দ্বিতীয় দফায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার কাটাখালী, জালিয়ার চর, চরলক্ষ্মী, কানিবগার চর, টুনুর চর ও ঘাষিয়ার চর এলাকা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল এলাকার নদী, সংযুক্ত খাল, বসতঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট এখন হাঁটু এবং কোমর পানিতে ডুবে আছে।

রাজশাহী : শিব ও বারনই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মোহনপুরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাগমারায় বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল।

সদরপুর (ফরিদপুর) : সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলায় পদ্মা নদীর ভাঙনে প্রায় ৩০টি বাড়ি, ২৫ বিঘা ফসলি জমি ও বিভিন্ন প্রজাতির দুই শতাধিক গাছ বিলীন হয়ে গেছে।

নেত্রকোনা : অবিরাম বৃষ্টিতে স্বোমেশ্বরী, কংশ, মগড়াসহ বেশকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। কংশ ও উদ্ধাখালী নদীসহ হাওর বিলের পানি বেড়ে বিভিন্ন সড়কে ওঠে পড়েছে।

নওগাঁ : আত্রাই নদীর পানি আরও বেড়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৮টি স্থান ভেঙে গেছে। এর মধ্যে মান্দায় ৬টি, আত্রাইয়ে ১টি ও পত্নীতলায় ১টি ভেঙেছে। মান্দায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল পর্যন্ত) তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার ১১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়ে পড়ায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

জয়পুরহাট : জয়পুরহাটের তুলসীগঙ্গা নদীর কালিতলা এলাকায় গতকাল বিকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২০ মিটার ভেঙে যাওয়ায় এবং ছোট যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদর উপজেলার পাঁচবিবি, ক্ষেতলাল, আক্কেলপুর ও সদর উপজেলার কমপক্ষে ১০টি ইউনিয়নের ২৫ গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে।

শেরপুর : শেরপুর পৌরসভার সীমানা বরাবর বয়ে যাওয়া পাহাড়ি মৃগী নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। ফলে পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কসবা ভাটিপাড়া মহল্লার বেশ কয়েকটি বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে পুরনো কবরস্থান ও একটি মসজিদ। উত্তরাঞ্চলে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে আরও সেনা মোতায়েন : স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে গাইবান্ধা সদরে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সেখানকার বাঁধ পুনর্নির্মাণে সেনাবাহিনীর ৩ প্লাটুন সদস্য ৫টি স্পিড বোট ও অন্য প্রয়োজনীয় উদ্ধার সামগ্রীসহ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৯ পদাতিক ডিভিশন হতে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষক দল গতকাল সিরাজগঞ্জের বন্যাদুর্গত এলাকা কাজিরপুরের বাহুকায় গিয়ে দুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণ করে।

এক সপ্তাহের মধ্যে তলিয়ে যেতে পারে ঢাকার নিম্নাঞ্চল : আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার পূর্বাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গতকাল মতিঝিলে পাউবোর প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ আশঙ্কার কথা জানানো হয়। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম জানান, রাজধানীর নিম্নাঞ্চল পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে প্লাবিত হতে পারে। ঢাকার আশপাশের নদীর পানি বাড়ার কারণে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ত্রিমোহিনী, দাসেরকান্দি, ফকিরখালী, বেরাইদসহ আশপাশের এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে। এসব এলাকা সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থার বাইরে।

বর্ষাকালে প্রতিবছরই এসব এলাকা জলাবদ্ধ থাকে। এর বাইরে ডেমরার আমুলিয়া, পাইটিসহ আশপাশের এলাকা এবং বাসাবো, মাদারটেক, নন্দীপাড়া এলাকা বন্যার কবলে পড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের বন্যা পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় রাজধানীর নিম্নাঞ্চলের ৪০ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হবে।

পাউবোর তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সবগুলো নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এই পানি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী নদীপথে ঢাকা এবং চারপাশের নদীগুলোয় ঢুকবে। নদীগুলোর পানি এখন পর্যন্ত বিপদসীমার নিচে রয়েছে। তবে দ্রুত বিপদসীমার ওপরে উঠে যেতে পারে। ২১ আগস্ট অমাবস্যার কারণে পানি বঙ্গোপসাগরে যাবে ধীরগতিতে। ফলে এ পানি সরতে সময়ও লাগবে।

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন