ঢাকাকে ঘিরে ফেলেছে বন্যা

  17-08-2017 01:13PM

পিএনএস ডেস্ক: বন্যার পানি এবার দেশের মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে চলে এসেছে। ঢাকার চারপাশ ঘেরা চার নদ-নদী—বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার পানি দ্রুত বাড়ছে।

সবচেয়ে বেশি বিপদের ডাক শোনা যাচ্ছে শীতলক্ষ্যায়। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল বুধবারের পূর্বাভাস সত্যি হলে আগামীকাল শুক্রবার থেকেই ঢাকাসংলগ্ন শীতলক্ষ্যার পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পরবর্তী তিন-চার দিন তা আরো বাড়তে থাকবে। ওই কেন্দ্রের বন্যা মানচিত্রে পানির স্তর নির্ধারণী চিহ্নে এমনই অবস্থান দেখানো হয়েছে। এমনকি শীতলক্ষ্যার লাখপুর প্রান্তে গতকালই পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে উঠে গেছে, যা নারায়ণগঞ্জ ছাপিয়ে সহজেই যেকোনো সময় ঢাকায় ঢুকে পড়বে পূর্ব দিক দিয়ে। কারণ বড় ঝুঁকির বিষয় হয়ে রয়েছে ঢাকার অরক্ষিত পূর্বাঞ্চল। এ অঞ্চল সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের লাখো মানুষের জন্য।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকার চারদিকের নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যদিও শীতলক্ষ্যা ছাড়া অন্যগুলোর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে আছে। অন্যদিকে পদ্মা ও শীতলক্ষ্যার পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠছেই। এ ক্ষেত্রে সব কিছুই নির্ভর করছে আগামী দু-তিন দিন পানি উজান থেকে যমুনা হয়ে মধ্যাঞ্চল থেকে কতটা দ্রুত নেমে যেতে পারে তার ওপর। যদি পানি নামার গতি মন্থর হয় তবে যেমন ঢাকার জন্য বিপদ বয়ে আনবে তেমনি ওই বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে যদি আবার টানা বর্ষণ ও উজানের পানি বাড়তে থাকে।

এ বছর মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওই তিন বছরই বাংলাদেশে বড় বন্যা হয়েছে। তাই এ বছরও বড় বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েকজন আবহাওয়াবিদ ও গবেষক। এ ক্ষেত্রে অন্য সববারের মতোই বন্যার পানি ঢাকায় ঢুকবে পূর্বাঞ্চলের অরক্ষিত বন্যাপ্রবণ এলাকা দিয়ে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ঢাকায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। একই কথা বলেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকাকে বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য সরকারের প্রস্তাবিত ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ নির্মাণের ওপর জোর দিয়ে আসছেন। কিন্তু ১৯ বছর ধরে অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে ওই এলাকা। এবার পূর্বাঞ্চলীয় নিচু এলাকাগুলোতে পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আরো বেড়ে গেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুসারে গতকাল পদ্মার গোয়ালন্দে পানি বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও ভাগ্যকুলে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে ধলেশ্বরীর এলাসিন পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ পড়েছে বন্যার কবলে। এ ছাড়া একই সূত্র অনুসারে দেশের অন্য সব এলাকায় বন্যার কিছুটা উন্নতি হলেও বা কিছু নদ-নদীর পানি কমলেও পদ্মার পানি আগামী ৭২ ঘণ্টা বাড়তে থাকবে।

কেন্দ্রের ৯০টি পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুসারে গতকাল ৬০টি পয়েন্টের পানি বিভিন্ন হারে বেড়েছে এবং ২৬টি নদীর পানি আগের তুলনায় কমেছে। অন্যদিকে ৩৯টি পয়েন্টের পানি রয়েছে বিপৎসীমার ওপরে।

ইতিমধ্যে দেশের ২৬ জেলা বন্যার কবলে পড়লেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ যাচ্ছে না, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ পানি। স্বল্পতা রয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, টিউবওয়েল ও শৌচাগারের। মাত্র সাতটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে ১ হাজার ৫৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য। সর্বোপরি কাজের ক্ষেত্রে এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের নেই সমন্বয়।

দুর্যোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৯ থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্যায় ৩৩ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর। তবে এদের মধ্য অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্তকে সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের। এদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল এবং পৌনে ২ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, এবারের মৌসুমি বায়ুর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গতিপ্রকৃতি ও প্রবাহের উৎসস্থল ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে প্রবাহিত শক্তিশালী বায়ু দুই পথে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর একটি পথ বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (সাধারণত টেকনাফ) থেকে স্থলভাগে প্রবেশের। অন্য পথটি সোমালিয়ার কাছ থেকে আরব সাগরের ওপর দিয়ে ভারতে প্রবেশের।

সাধারণভাবে জুনের প্রথম সপ্তাহে এই দুই পথে মৌসুমি বায়ু প্রবেশের পরই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। মৌসুমি বায়ু যতই বিস্তৃত হয়, ততই বাড়তে থাকে বৃষ্টিপাতের অঞ্চল। এ বছর এই মৌসুমি বায়ুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দুই পথেই প্রবাহ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দুটি প্রবাহ একত্র হয়ে (ক্রস ইকুইটেরিয়াল ফ্লো) মৌসুমি বায়ুর অক্ষকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া।

গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই ‘ক্রস ইকুইটেরিয়াল ফ্লো’র প্রভাবে মৌসুমি বায়ুর অক্ষ হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত ও সক্রিয়। আবার এর বর্ধিত একটি অংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ও সক্রিয়।


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন