প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এতো আলোচনার কারণ কি?

  21-08-2017 06:12PM

পিএনএস (জে এ মোহন): উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণে সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়কে কেন্দ্র করে উচ্চ আদালত যেন এখন রাজনৈতিক মাঠে পরিণিত হয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের অনুলিপি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

একটি স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে উচ্চ আদালত। কোথাও বিচার না পেয়ে থাকলে মানুষ আদালতের ধারস্থ হয়ে থাকেন। আর বুক ভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন দেখে আদালত থেকেই সঠিক বিচার পাওয়ার। গ্রাম্য সালিসে দেখা যায় বাদি-বিবাদি এমন মনভাব নিয়ে থাকেন যেন ‘বিচার মানি, তাল গাছ আমার’।

কিন্তু সালিসে যারা বসেন তাঁরা সঠিক বিচার করতে গিয়ে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে রায় যায়। আর যার বিপক্ষে রায় যায় সে সাধারণত এই রায় মানতে নারাজ। তখন পাগলের মত বলে উঠে চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউই বিচার জানেন না।

এটা একজন গ্রামের সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে এটা বলা স্বাভাবিক। তার অজ্ঞতাই এর কারণ। আমাদের মানসিকতা এমন হয়েছে আমরা কখনো ভুল করতে পারি না। তাই সবসময় ‘বিচার মানি, তালগাছ আমার’ নীতিতে থাকি।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে দেশে চলমান রাজনৈতিক বক্তব্যে এখন উচ্চ আদালত যেন রাজনৈতিক মাঠ হয়ে গেছে? পক্ষে গেলে সাবাস, বিপক্ষে গেলে সর্বনাস। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়।

আমরা যে কোনো বিষয়ে পার্শ্ববর্তী বন্ধু দেশ ভারতকে অনুকরণ করে থাকি। ভারতের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রসারিত মৌলিক এখতিয়ার সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন সরকারগুলির অভ্যন্তরীণ বিবাদ নিরসণের জন্যও এই আদালত কাজ করে। উপদেষ্টা আদালত হিসেবে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিশেষত সংবিধানের অধীনস্থ বিষয়গুলির শুনানি গ্রহণ করে। আবার কেউ এই আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও, এটি নিজে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ (বা ‘সুয়ো মোটো’) করতে পারে।

যদিও আমরা তাদের আচার–আচরণ, ফ্যাশন, পোশাক সবকিছুতেই অনুকরণ প্রিয়, এমনকি ভারতে কোনো অঘটন ঘটলেও সেই ঘটনার অনুকরণ করে থাকি তবে ভারতের উচ্চ আদালতের যে স্বাধীনতা আছে বাংলাদেশে কি সেটা আছে? এখানে যে কোনো সরকারের আমলেই বিচার বিভাগ প্রশ্নবৃদ্ধ কেন?।

রাজনৈতিক ভাবে সর্ব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা একটি দেশের জন্য কতটা শুভ? কথায় আছে যে গর্ত আজ অন্যের জন্য করা হচ্ছে, সেই গর্তে নিজেও যে পরবো না, সেই নিশ্চয়তা কতটুকু? জনগণের প্রজাতন্ত্র দেশ যদিও বলা হয়, জনগণই সকল ক্ষমতার উর্ধে।কিন্তু এর সুফল আদও কি সাধারণ মানুষ পায়?

দেশের সকল উন্নয়ন জনগণের জন্য। জনগণের জন্য রাজনৈতিক দল কিন্তু জনগণ আজ রাজনৈতিক মারপেচে শুধু মরিচে পরিণিত হচ্ছে।উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে দেশে চলমান যে বির্তক বিরাজ করছে তাতে উচ্চ আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কি বাড়বে?

দেশের জ্ঞানি ও সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা উচ্চ আদালত নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে সাধারণ মানুষও অনেক জ্ঞানি হচ্ছে। তবে নিম্ন আদালত বা উচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বির্তকের অবসান কি? আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায় নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তাহলে এই বির্তকের জন্ম কেন?

প্রশ্ন, তাহলে বারবার কেন রাজনৈতিক নেতারা প্রাধান বিচারপতি বিরুদ্ধে বক্তব্যে দেবে? এতে কি আদালত অবমাননা হয় না?

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘‘আপনারা প্রধান বিচারপতি ও কোর্টের স্বাধীনতা খর্ব করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন আমরা কি কিছুই বলতে পারব না? আমরা কি কোর্টে বসে মন্তব্য করতে পারব না?’’

নিম্নে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায় নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:-

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায় প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রায়ের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতিকে কোনো ধরনের চাপ দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে দলের মন্ত্রী ও অন্যান্য নেতা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা তাঁদের নিজস্ব। তিনি বলেন যাঁরা উদাহরণ দিতে গিয়ে পাকিস্তানকে টেনে আনছেন, তাঁদের ইতিহাস ও দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি পাঠ করতে হবে। কারণ, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ এক জিনিষ নয়।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেছেন, প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।তিনি বলেন, ‘নজিরবিহীনভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রধান বিচারপতির বাসায় নৈশভোজের নামে বৈঠকের পর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের বৈঠক হয়; বৈঠকে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করার প্রসঙ্গ নিয়ে এখন চারদিকে মানুষের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে দাবি করেন।’

সুযোগ থাকলে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এমপি।

এদিকে বিএনপি এখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার পরম বন্ধু বলে উল্লেখ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বাঙালি জাতি বীরের জাতি। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এই জাতিকে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা কারও নাই, এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে। কেউ যদি অন্যায় কিছু চাপিয়ে দিতে চায়, সেটা জনগণ রুখে দেবে।

আবার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও তৃণমূল বিএনপির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেছেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা অবশ্যই জাতীয় সংসদের হাতে থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে এক বক্তব্যে বলেন, মিডিয়াতে অনেক কথা বলছেন। কোর্টে এসে অন্য কথা বলেন। আপনাকে নয়, আপনাদের বলছি- বলেন কবে কি হবে। আপনারা ঝড় তুলছেন, আমরা কোনো মন্তব্য করেছি? ধৈর্য ধরেছি, যথেষ্ট ধরেছি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে (নওয়াজ শরীফ) ইয়ে (অযোগ্য) করেছেন। সেখানে কিছুই (আলোচনা-সমালোচনা) হয়নি। আমাদের আরো পরিপক্কতা দরকার।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের বিষয়ে বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফাইড কপির জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে। রায়টি আরও পরীক্ষা করা হচ্ছে। আরও পড়ে দেখা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী বলেন, রায়ের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় এবং আপত্তিকর যে কথাগুলো উঠে এসেছে, সেগুলো সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখানো স্বাভাবিক। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ উগ্র কোন প্রতিক্রিয়া না দেখায় বা প্রতিক্রিয়ার কোনো ভাষায় আদালত অবমাননা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এসব ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখানো অন্যায় নয়। তিনি বলেন, সরকার রায়ের সঙ্গে হয়তো একমত পোষণ করে না কিন্তু রায়কে শ্রদ্ধা করে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে যে রায় প্রকাশ করেছেন তা দেশের ইতিহাসে মাইলফলক। এ রায়ের ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন ফিরে এসেছে। যারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। যারা এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা কি বিচার বিভাগের স্বধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করে আন্দোলন করে রায় পাল্টাবেন। আন্দোলন করে এই রায় পাল্টানো সম্ভব নয়। আপনারা সুপ্রিম কোর্টের মানসম্মান ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।

(লেখক, সাংবাদিক পিএনএস, জামিল আহমদ মোহন, সাধারণ জনগণ)

পিএনএস/আলআমিন


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন