কৌশলে রোহিঙ্গা নিধনের সাফাই সু চির কণ্ঠে

  20-09-2017 08:23AM


পিএনএস ডেস্ক: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে টানা ২৭ দিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে সামরিক বাহিনী। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, বসতিগুলো পরিণত করেছে বিরানভূমিতে। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্বসম্প্রদায় আশা করেছিল, শান্তিতে নোবেল পাওয়া নেত্রী মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি শেষ পর্যন্ত এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলবেন। কিন্তু সু চি তাদের হতাশ করেছেন। মাসখানেক ধরে রাখাইনজুড়ে নারকীয় তাণ্ডব চললেও তিনি মুখ খোলেননি। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে তীব্র সমালোচনা। তার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে সু চি যা বললেন তাতে হতাশা শুধু আরো কয়েক গুণ বাড়লই না, শান্তির দূত হয়ে অশান্তির আগুনে যেন ঘি ঢাললেন তিনি।

বিশ্ববাসী তাঁর ভাষণে সংকট সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পায়নি, বরং সু চির দেওয়া ৩০ মিনিটের ভাষণে মিথ্যার জলজ্যান্ত প্রমাণ পেয়েছে তারা। রোহিঙ্গারা তাদের আবাসস্থল রাখাইন থেকে কেন বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে, তাও এখনো জানেন না বলে বিদেশি কূটনীতিক ও সংবাদমাধ্যমে দেদার বলে গেছেন সু চি।

অথচ গত সোমবারও বিদেশি সংস্থাগুলো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পোড়াতে দেখেছে স্বচক্ষে; তবুও সু চির দাবি, ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে কোনো ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ হয়নি। যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূল বলে উল্লেখ করেছে। সু চি ভাষণে সমাধানের পথ খোঁজার বদলে সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা তথ্য প্রচার করায় দেশটির ওপর আরো ক্ষেপেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

সু চির ভাষণের পর বাংলাদেশের বিশ্লেষকরাও বলছেন, সু চি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের তদন্ত করার কথা বলা তো দূরের কথা, উল্টো রোহিঙ্গাদের নিজস্ব জাতিগত পরিচয় উল্লেখ না করে ‘মুসলমান’ হিসেবে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে দুষ্কৃতকারী সেনাবাহিনীকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন।

গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে নিরস্ত্র হাজারো রোহিঙ্গা। মায়ের কোল থেকে নবজাতক শিশুকে কেড়ে দিয়ে ছুড়ে দিয়েছে জ্বলন্ত আগুনে। স্বামী-সন্তানের সামনে স্ত্রী, মা-বাবার সামনে ধর্ষণের শিকার হয়েছে হাজারো মেয়ে। প্রাণ বাঁচাতে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা গত তিন সপ্তাহেই বাংলাদেশে ঢুকেছে। আসার পথে সীমান্তে পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। নৌকা ডুবে মারা গেছে কয়েক শ নারী ও শিশু, যাদের লাশ ভাসতে দেখা গেছে নাফ নদে। মিয়ানমারের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে বিশ্ব যখন সরব, তখন সু চি মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। সমালোচনার ভয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ না দিয়ে গতকাল পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে মিথ্যার মালা গাঁথলেন, যে মালায় হাজার বছর ধরে রাখাইনে বাস করা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আশ্বাস নেই, তাঁদের নাগরিক অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নেই। হাজারো রোহিঙ্গাকে হত্যাকারী সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলা নেই। রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয়ও তুলে ধরেননি সু চি, চিহ্নিত করেছেন মুসলমান হিসেবে। সু চি একবারই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন মিয়ানমারের দৃষ্টিতে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) নাম বলার প্রয়োজনে।

সু চির ভাষণ শুনে হতাশা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সু চি যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে উত্ফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। তিনি এমন কিছু বলেন নাই যাতে বাংলাদেশ বা আন্তর্জাতিক মহল আশ্বস্ত হতে পারে। তিনি রোহিঙ্গারা কেন মিয়ানমার ছাড়ছে তার কারণ খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন। এটা কোন ধরনের কথা? চার লাখ মানুষ জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আর এখন উনি বলছেন, কেন পালিয়েছে তার কারণ জানেন না। ’

ড. ইমতিয়াজ আরো বলেন, ‘সু চি ইংরেজিতে বক্তব্য দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। একদিকে বক্তব্যে আমাদের গণতন্ত্র এখন শিশু, তাকে বাঁচাও—এমন ভাব প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীকেও হাতে রাখতে চাইছেন। কাজেই মিয়ানমারের ওপর যে আন্তর্জাতিক চাপ শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা যেন তাড়াতাড়ি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারি, সে জন্য জোরালো তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। ’

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ‘যাচাই’ করে যেকোনো সময় ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলেছেন সু চি। তবে সেই পরীক্ষায় আগে থেকে বাংলাদেশে আসা চার লাখসহ বর্তমানের চার লাখের মধ্যে কতজন উত্তীর্ণ হতে পারবে, বাংলাদেশি বিশ্লেষকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সু চির বক্তব্য সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, ভাষণে সু চি বললেন, ‘অর্ধেকেরও বেশি রোহিঙ্গা বৈষম্যহীনভাবে রাখাইনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো সুবিধা পাচ্ছে। ’ তাঁর এ বক্তব্যকে ‘সন্দেহজনক’ ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে সু চি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা বলেছেন। ‘আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইন-শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই। সংঘর্ষের শিকার জনগণের দুর্ভোগের বিষয়টি আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করি’,বলেছেন সু চি।

সুচি বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত করতে পারি যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের যাচাই করে ফেরত আনার প্রক্রিয়া আমরা যেকোনো সময় শুরু করতে পারি। যারা উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত হবে, তাদের সব ধরনের মানবিক সহায়তা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই ফিরিয়ে আনা হবে। ’ নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় তাদের ফেরত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। তবে তাঁর এই বক্তব্যে ভরসা করতে পারছে না আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, সু চি ভাষেণে বলেননি যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে কতজন ওই যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। যদিও তিনি ফেরত নেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু কে নিশ্চিত করবে যে তাঁরা মিয়ানমারের নাগরিক?

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ‘সু চি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে ওই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট হলো, শুধু যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে সম্মতি দেবে, তাদেরই ফেরত পাঠানো যাবে। এর আগে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সময় দেখা গেছে, অনেকে ফেরত যেতে চায় না। ফলে আমরা সবাইকে ফেরত পাঠাতে পারিনি। ’

নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনুপ কুমার আরো বলেন, ‘সেখানে প্রত্যেক গ্রামের প্রতিটি বাড়ির একটি তালিকা আছে, যাকে তারা (মিয়ানমার) হাউসহোল্ড লিস্ট বলে। প্রত্যেক গ্রামের একজন প্রধান থাকেন। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে প্রধান করা হয়। সরকার তাঁকে নিয়োগ দেয়। যাচাই-বাছাইয়ের সময় গ্রামের প্রধান ওই গ্রামের বাসিন্দাদের পরিচয় নিশ্চিত করে থাকেন। ’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ফেরত নেওয়ার সময় একটি প্রক্রিয়া অবশ্যই নির্ধারণ করা হবে। তবে সব সময়ই যে পরিমাণ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে, এর সবগুলোকে ফেরত নেয় না। সু চি ভাষণে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেননি। ফলে তাঁর বক্তব্যে পুরো সংকটের সমাধানের কথা নেই।

সু চি বলেছেন, রাখাইনে যে সংকট শুরু হয়েছে, এর মূল কারণ তিনি জানেন না। যদিও তিনি বারবার আনান কমিশনের রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন ভাষণে। গত আগস্টে প্রকাশিত ওই রিপোর্টেই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর অন্যতম কিছু কারণ বলা আছে। তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দেওয়া, সেনাবাহিনী ও পুলিশের আক্রমণ-নির্যাতন এবং তাদের প্রতি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যকে দায়ী করা হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর পুলিশের আক্রমণের কথা উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, তখন প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে চলে এসেছে। তবে সু চি বলেছেন, ‘যারাই এর সঙ্গে জড়িত থাকুক, ধর্ম, রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

সু চির ভাষণে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে কিছুই না থাকা সম্পর্কে অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ‘সু চির বক্তব্যের মধ্যে থেকে ইতিবাচক দিকগুলো খুঁজে বের করতে হবে, যা চলমান সংকট উত্তরণে সমাধানের পথ দেখাবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আশা করেছিলেন সু চি তাঁর দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বলবেন, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলবেন। ’

সু চি ভাষণে বলেছেন, গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে কোনো ক্লিয়ারেন্স অপারেশন হয়নি। তাঁর এ বক্তব্যের বিপক্ষে তথ্য-প্রমাণের কমতি নেই কারো কাছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বিসিসি, এএফপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমের কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁরা গত সোমবারও রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে আগুন দিয়ে পোড়াতে দেখেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মী ফিল রবার্টসন প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘সু চির বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে দুই সপ্তাহ ধরে যে গ্রামগুলো পুড়ছে, সেখানে কারা আগুন দিয়েছে?’

অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ‘সু চি বলেছেন ৫ সেপ্টেম্বরের পরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্লিয়ারেন্স অপারেশন (সন্ত্রাসমুক্তকরণ অভিযান) চালায়নি। এ বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনি পরোক্ষভাবে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন। ’

মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতন করছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। গত ৫ সেপ্টেম্বরের পরও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার প্রাণহানি হয়েছে, বাংলাদেশেও তাদের ঢল থামছে না।

কারাবন্দি সু চির মুক্তি ও তাঁকে বিশ্বের সামনে ‘ডার্লিং নেত্রী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর সেনাশাসন হটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ নির্মাণ করেছে যেসব দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, তারাই এখন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় সু চির ওপর ক্ষেপেছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ভাষণে সু চি বললেন, ‘বর্তমানে মিয়ানমারের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ রয়েছে। তবে আমার সরকার আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকে ভয় করে না। ’

রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনে বিশ্ব সোচ্চার হওয়ার সমালোচনা করে সু চি বলেছেন, ‘এটি খুবই দুঃখজনক যে বিশ্ব সম্প্রদায় পুরো মিয়ানমারের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শুধু দেশের একটিমাত্র অংশের সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। যদি আপনাদের আগ্রহ থাকে, আমাদের সঙ্গে আসেন, দেখেন। আমাদের জানান। আমরা আপনাদের ওই সব এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। যারা ওই সব এলাকায় আছে, তাদের কাছে জানতে চাইব, কেন তারা যায়নি। কেন তারা নিজেদের গ্রামেই থাকতে পছন্দ করছে। ’

সু চির বক্তব্য শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ বলেছে, রাখাইনে কী হয়েছে, তা স্বচক্ষে দেখার জন্য জাতিসংঘের তদন্তদলকে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে হবে।

‘মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে এত কিছু করার পরও বিশ্ববাসীকে কেন সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না?’ এমন এক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে সু চি বলেন, মুসলমানরা গোলযোগপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে, সেখানে স্বাস্থ্যসেবা ও রেডিও সম্প্রচারের ভালো ব্যবস্থাও রয়েছে।

সু চির বক্তব্যের সমালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিচালক জেমস গোমেজ বলেন, ‘মিয়ানমারের যদি কোনো কিছু গোপন করার অপচেষ্টাই না থাকে, তাহলে জাতিসংঘের তদন্তদলকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া হোক। ’

সু চি তাঁর বক্তব্যে এমন কথা বললেও বাস্তবে রাখাইন রাজ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও কূটনীতিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ, তারা ত্রাণ নিয়ে রাখাইনে যেতে চাইলেও যেতে দেওয়া হয়নি। গত জানুয়ারিতে জাতিসংঘের একটি দল সেখানে যেতে চাইলেও ‘নিরাপত্তা অজুহাতে’ ঢুকতে দেয়নি মিয়ানমার সরকার। সহায়তাকারী সংস্থা ও এনজিওকর্মীদের রাখাইনে ঢুকতে না দেওয়ায় গত ডিসেম্বরে কফি আনানও মিয়ানমার সরকারের সমালোচনা করেন।

সু চি তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সমস্যা সমাধানে বারবার আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন ‘জয়েন আস’ বলার মধ্য দিয়ে। তিনি কোনোমতেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমালোচনার দিকে যাননি। অথচ এই সেনাবাহিনীই রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণসহ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। বরং উল্টো কথা বলেছেন সু চি—‘নিরীহ সাধারণ মানুষ, তাদের সম্পদের কোনোমতেই কোনো ক্ষয়ক্ষতি না করে কোড অব কন্ডাক্ট কঠোরভাবে মেনে চলতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাখাইনে এখনো ৫০ শতাংশেরও বেশি রোহিঙ্গা কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই বসবাস করছে। এমনকি ওই সব গ্রামে কোনো ধরনের সংঘর্ষ স্পর্শ করেনি। আমরা নেতিবাচক জিনিসগুলো দূর করে ইতিবাচকতা ফিরিয়ে আনব। ’

শক্তিশালী সেনাবাহিনীর তুলনায় নিজের দুর্বলতার কথাও স্বীকার করতে ভোলেননি সু চি। বলেছেন, ‘মানুষ আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে যে অল্প সময়ের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হবে। এটা মনে রাখা দরকার যে আমাদের বেসামরিক সরকার গত বছর ক্ষমতায় এসেছে। আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি, তা সমাধানের জন্য ১৮ মাস খুবই কম সময়। ’

সু চির ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে কেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে, তা জানার জন্য সু চির উচিত বলে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ঘুরে তাদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া। কয়েক মাস আগে মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। আমরা তাঁকে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে যেতে প্রস্তাব করেছিলাম, তবে তিনি রাজি হননি। ’

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন