মিয়ানমারের পাতা ফাঁদে কি পা দিলাম?

  24-09-2017 03:00PM

পিএনএস ডেস্ক : অং সান সু চির মুখে মানবতার কথা শুনে পুরান ঢাকার ঘোড়াগুলো পর্যন্ত হেসে উঠতে পারত। কিন্তু সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকারের উপদেষ্টা বলে কথা। হাসা বারণ। আমরা হাসতে পারছি না, জগতের লাঞ্ছিত-ভাগ্যহতদের দুঃখ আমাদের কাঁদাচ্ছে। আমাদের জন্য কান্না আর মিয়ানমারের জন্য ভারতের অস্ত্র আর চীনের অর্থ। একেবারে সোনায় সোহাগা। আর আমাদের নাফ নদী যত না পানি, তার চেয়ে বেশি দুঃখের দরিয়া। বেরহম পৃথিবীতে বাংলাদেশ একা। পিঠ চাপড়ানোর অনেকে আছে, পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।

এবারে মিয়ানমার আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। এক মাসের মধ্যে তাদের চার লাখের বেশি মানুষকে বাংলাদেশের কোলে তুলে দিল। গণহত্যার তোড় চালাবার পর ‘ভালমানুষী’ বক্তৃতা দিলেন মুখ দেখালেন সেই রাষ্ট্রের মুখপত্র। সঙ্গে চীন‍+রাশিয়া+ভারতের সমর্থন। আমরা শুধু দেখাতে পারলাম মানবেতর শরণার্থীদের কিছু ছবি। বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ল, কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের শিঁকে এতটুকুও ছিঁড়ল কি? তারা কি ফিরতে পারবে সহসা? ‘রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী’, ‘সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী’ খেতাব ঘুচবে কি?

মনে হয় না।

রোহিঙ্গাদের পাশে বাংলাদেশ, কিন্তু বাংলাদেশের পাশে কে? দুই কাঁধে দুই বন্ধুর স্বার্থের ভার আমরা বহন করলেও বিপদের দিনে আমাদের বাড়ানো হাত তারা ধরেনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর বহুল প্রতীক্ষিত বক্তৃতার সময়ও বেশির ভাগ আসন ফাঁকা ছিল। ভাবা দরকার, কীভাবে কোন কারণে এমন নিঃসঙ্গ দশায় আমরা পড়ে গেলাম? বিরোধী দল নিয়ে মাতোয়ারা হতে গিয়ে আরও বড় বিপদের দিকে সরকার মনে হয় পেছন ফিরেই ছিল। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কি আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যাচ্ছে? উত্তর খুঁজতে হবে।

মিয়ানমারের পরের পদক্ষেপগুলো কী হবে? কীভাবে তা আমরা সামাল দেব? উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রটি অনুতাপহীনভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে যাচ্ছে। এশিয়া টাইমসে সাংবাদিক বার্টিল লিন্টনার রেঙ্গুন শহরে বসে লিখেছেন, বর্মী সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন থামেনি। সু চির দাবি সত্য নয়। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে ৭০ ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ ৩০-৩৫ হাজার সৈন্য। আরসা নামক এক ভুঁইফোড় সংগঠন—আদিম ও চুরি করা কিছু অস্ত্রই যাদের সম্বল, তাদের হাতে গোনা সদস্যদের ধরতে সীমান্ত প্রদেশে এত বড় সেনা সমাবেশের দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে না সীমান্তে মাইন পুঁতে এলাকাটিকে মানব বিধ্বংসী করে তোলার। এটা করা হয়েছে কৌশলগত কারণে।

লিন্টনার বর্মী সেনাবাহিনীর ভেতরের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছেন, রাখাইন প্রদেশের তিনটি বড় জনপদের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা নষ্ট করা তথা জনমিতিক পরিবর্তন আনাই তাদের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য। রাখাইনে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার সঠিক তথ্য জানা যায় না। আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হয় না।

দ্বিতীয়ত, প্রকৃত সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়। সেখানে সর্বশেষ ১১ লাখ রোহিঙ্গা ছিল বলে ধারণা করা হয়। এবারে আসা সাড়ে চার লাখ বাদ দিলে আর থাকার কথা মাত্র পাঁচ-ছয় লাখ মানুষ। আর একটি ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ই রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করার জন্য যথেষ্ট।

দুটি গণহত্যার মধ্যে মানুষের আসার ধারাও চলতে থাকবে। এভাবে রাখাইনের রোহিঙ্গারাই শুধু বিলুপ্ত হবে না, মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘুরা লঘু থেকে আরো লঘুতর হবে। এই কাজ তারা শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই করছে না, করছে খ্রিস্টান ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও। বর্মী জাতীয়তাবাদের ‘অপর ভীতি’ ইসরায়েলের মতো একধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। মিয়ানমারের এই নীলনকশাটি কি আমরা পাঠ করতে পেরেছিলাম?

রাখাইনের মংডু, বুথিয়াডং ও রাথেদং হলো রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর। এবারের জাতিগত নিধন ও বিতাড়নের প্রধান শিকারও এসব অঞ্চল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভিডিও ও স্যাটেলাইট ছবি প্রমাণ, শুক্রবারও অনেকগুলো রোহিঙ্গা গ্রাম পোড়ানো হয়েছে। এর আগের স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা যায়, প্রায় আড়াই শ রোহিঙ্গা গ্রাম এমনভাবে জ্বালানো ও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সেখানে মানববসতির কোনো চিহ্নই না থাকে।

আগস্টে সেই গ্রামগুলো ছিল সবুজ এবং জীবন্ত, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সেসব পুড়ে লাল হওয়া বধ্যভূমির চেহারা পেয়েছে। আশপাশের বনজঙ্গলও নিশ্চিহ্ন। যাতে সেই পোড়ামাটিতে ফেরার আশা নাফ নদীতে চিরতরে জলাঞ্জলি দিতে হয় রোহিঙ্গাদের।

২০১২ সালের রোহিঙ্গা নিধনের পর মিয়ানমারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগণ নয়, বিতাড়নই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। তৃতীয় কোনো দেশ চাইলে সেখানেও তাদের পাঠানো হবে।’ অর্থাৎ, দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিতাড়ন তো চলছেই, তৃতীয় দেশেও সেটা চলতে পারে। এমন চিন্তা মগের মুল্লুকে বসে করা সম্ভব, বাংলাদেশের দুশ্চিন্তাটা সেখানেই।

(ফারুক ওয়াসিফ, ২৮-৭-২০১২, প্রথম আলো) সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে। বাংলাদেশ ছাড়া তৃতীয় কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের নিতে রাজি না হওয়া মানে, মিয়ানমার সচেতনভাবে বাংলাদেশকেই তাদের নাগরিক খালাসের উন্মুক্ত উপায় ভাবছে। তাদের পরিকল্পনা তারা গোপন করেনি, আমরাই শুধু বেহুঁশ হয়ে ছিলাম।

আরাকানের ওপর এ বছর প্রকাশিত একটি বই হাতে এসেছে। নাম, ‘মিয়ানমারস এনিমি উইদিন’। লেখক, ফ্রান্সিস ওয়াদে। বইটির একটি অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে, কীভাবে মিয়ানমারের দাগি অপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে পরিত্যক্ত রোহিঙ্গা ভূমিতে আবাদ করতে দেওয়া হচ্ছে। একদিকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন অন্যদিকে বহিরাগত বর্মীদের বসতায়ন ইসরায়েলি কৌশল। খেলারাম খেলে যান, ভোলারাম ভুলে যান।

১৯ তারিখের বক্তৃতায় সু চি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে কাগজপত্র যাচাই করে ফেরত নেওয়ার কথা বললেন। বললেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পরে রাখাইনে কোনো সেনা অভিযান চলছে না। সব যে ডাহা মিথ্যা, তা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকেরই নাগরিক পরিচয়পত্র আছে। যে রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না, তাদের নির্মূলই যাদের লক্ষ্য, তারা কীভাবে আরাকানে তাদের কয়েক শতকের নাম-সাকিনের প্রমাণ দেবে? মিয়ানমারের স্বেচ্ছাচারী যাচাইকরণের ছাঁকনিতে বেশির ভাগ শরণার্থীই আটকে যাবে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলতে চাইবে তারা। তারপর তক্কে তক্কে থাকবে, আবার কখন বাদবাকি রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা যায়।

১৯৭৮ সালের পর থেকে এক দিনের জন্যও মিয়ানমার এই পথ থেকে সরে আসেনি। তাদের কৌশল খেয়াল করলেই জিনিসটা স্পষ্ট হয়। ১৯৯১-৯২, ২০১২ এবং ২০১৬ সালেও বড় আকারে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। এর মধ্যে মধ্যে চলেছে রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণের সব আয়োজন। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের শক্ত প্রতিরোধের কারণে অধিকাংশ শরণার্থী ফেরত নিতে হয়েছিল। ২০১১ সালে মিয়ানমার সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ হাজার শরণার্থীকে ফেরত নিতে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার কথা রাখেনি। বরং পরের বছর তাড়িয়েছিল হাজারো রোহিঙ্গাকে।

২০১২ ও ২০১৬, দুবারই মিয়ানমার ক্রিয়া করেছে আমরা করেছি প্রতিক্রিয়া। তারা লাখো মানুষ ঠেলে দিয়েছে, আমরা তাদের নিতে বাধ্য হয়েছি। তারা করণ কারক, আর আমরা কর্ম কারক, তারা যা করতে চায় তা আমাদের দিয়ে করানো যায়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে কোনো ভুল নেই, ভুল হলো আগে-পরের কাজটি না করা।

মিয়ানমারের জাতিগত নিধন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়ে নাই আর, বাংলাদেশের জনগণও বিভিন্নভাবে এর ভুক্তভোগী। রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠা তাই আমাদের শান্তিরও শর্ত। রাখাইনের জনমিতি বদলে ফেলার স্বয়ংক্রিয় ফল হবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনমিতিক পরিবর্তন।

আমাদের অবস্থা মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছড়ার ভোলানাথের মতো।

‘ভোলানাথ লিখেছিল,
তিন-চারে নব্বই—
গণিতের মার্কায়
কাটা গেল সর্বই।’

মিয়ানমারের সামরিকতন্ত্রের দৃষ্টি অনেক দূরে, দিনে দিনে তারা সেখানে পৌঁছাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টি সম্ভবত কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত।

মিয়ানমার ফাঁদ পাতে, আর আমরা নিশি পাওয়া লোকের মতো আপন পায়ে হেঁটে হেঁটে তাতে ঢুকে পড়ি। অর্থনৈতিক-জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বিপুল। এই গুরুত্ব আদায়ে আমাদের হাতে থাকা হাতের কার্ডগুলো খেলতে পারিনি আমরা। আমাদের চোখ আকাশে, মাটির দিকে এখন না তাকালে বিপদ। ভূরাজনৈতিক খেলায় দূরদর্শিতা ও মানবিকতার পরীক্ষা আমাদের সামনে।

[প্রথম আলোর সৌজন্য, ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক]
[email protected]

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন