রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র : ইউনেসকোকে অগ্রাহ্য করেই প্রকল্প

  12-10-2017 09:37PM

পিএনএস ডেস্ক : জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) অনুরোধ অগ্রাহ্য করেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকাজ এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। তবে এগোনোর গতি ধীর। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অবকাঠামোর সাড়ে ৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ পেতে নির্ধারিত সময়ের চেয়েও প্রায় দুই বছর বাড়তি সময় লাগবে। ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে এর প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

প্রথম আলো থেকে ই-মেইলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র রামপাল নিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। সংস্থাটির পরিচালকের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর একটি পরিবেশের কৌশলগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) করার আগে সুন্দরবনের পাশে রামপালসহ কোনো ধরনের শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো করা যাবে না। গত জুলাই
মাসে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত এভাবেই বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছিল।

তবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ইউনেসকো রামপালের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। গত ৭ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ইউনেসকো রামপালের ব্যাপারে আপত্তি তুলে নিয়েছে। যখন ওই বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়, তখন পোল্যান্ডের ক্র্যাকাও শহরে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভা চলছিল, শেষ হয়নি।

পরে গত ৯ জুলাই বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করে উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ইউনেসকোকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি রামপাল প্রকল্পের বিষয়ে আপত্তি তুলে নিয়েছে। তাই প্রকল্পের কাজ চালাতে কারও আপত্তি নেই।

তবে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছিল, রামপাল প্রকল্প থেকে ইউনেসকো আপত্তি তুলে নেয়নি। জাতীয় কমিটি সরকারের বিরুদ্ধে রামপাল নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ তোলে। তারা ওই প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।

গতকাল এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান জানতে যোগাযোগ করা হয় পোল্যান্ডে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনের সঙ্গে। তিনি এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার রামপাল প্রকল্প ও এসইএ সমীক্ষা একসঙ্গে চালাবে। ওই সমীক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে কোনো পরামর্শ বা সুপারিশ থাকলে তা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেই তাঁরা মনোযোগ দিচ্ছেন বলে জানান।

তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ গতকাল এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, রামপাল প্রকল্প থেকে ইউনেসকো তার আপত্তি তুলে নিয়েছে বলে সরকার যা প্রচার করছে, তা মিথ্যার পর্যায়ে পড়ে। সরকার রামপাল বিষয়ে সামনে না গিয়ে পেছনের দিকে যাচ্ছে, যা সুন্দরবন ধ্বংস করবে এবং বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে একটি পরিবেশবিধ্বংসী দেশ হিসেবে তুলে ধরবে।

প্রথম আলোর প্রশ্ন, ইউনেসকোর জবাব
‘ইউনেসকো কি রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে? বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ব্যাপারে এটাই কি বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির অবস্থান? সরকার বলছে, কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ ও এসইএ সমীক্ষা পাশাপাশি চলবে—এ ব্যাপারে ইউনেসকোর অবস্থান কী?’—এসব প্রশ্নসংবলিত একটি ই-মেইল বার্তা ৭ অক্টোবর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে পাঠানো হয় ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের পরিচালক ড. মেশিল্ড রসলারের কাছে। ৮ অক্টোবর তিনি ই-মেইল বার্তার জবাবে জানান, এর উত্তর দেবেন বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের এশিয়া ও প্যাসিফিক ইউনিটের প্রধান ড. ফেং জিং।

৯ অক্টোবর ড. ফেং জিং ওই ই-মেইলের জবাবে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি সিদ্ধান্ত ৪১ সিওএম ৭বি.২৫ (জুলাই ২০১৭. ক্র্যাকো) দ্বারা সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) পরিচালনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপক্ষকে এই অনুরোধও জানিয়েছে যে তারা এসইএ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ কোনো বড় ধরনের শিল্প এবং/বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চালাতে না দেওয়ার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কিছু বলতে রাজি হননি। আর এ ব্যাপারে তৌফিক-ই-ইলাহীর মন্তব্য জানতে তাঁর অফিস ও মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

ইউনেসকোর ৪১তম সভায় সুন্দরবন নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ও ইউনেসকো ঢাকা কার্যালয় থেকে সহযোগিতা করবে। এসইএ সমীক্ষা করা এবং ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সুন্দরবন রক্ষায় একটি সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করবে, যা সুন্দরবনের অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করবে।

নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে
রামপাল প্রকল্পের অর্থায়ন ও ঠিকাদার ঠিক করার পর এখন চলছে মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে তাদের ওয়েবসাইটে বলা আছে, ২০১৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যে রামপাল থেকে বিদ্যুৎ আসা শুরু হবে। আর পুরো কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও ৬ মাস।

কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড (ভেল) বলছে ভিন্ন কথা। গত সেপ্টেম্বরে তারা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে, প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া শুরু হবে ২০২০-এর সেপ্টেম্বরে। আর পুরো কাজ শেষ হতে ২০২১-এর আগস্ট পর্যন্ত লেগে যাবে।

অন্যদিকে রামপালের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য সরকার থেকে আরও ৯২০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। সরকার থেকে এখন বলা হচ্ছে, সেখানে আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে না। হবে একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। আর তা নির্মাণ করছে প্রকল্পের মালিক বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি। কোম্পানিটি ইতিমধ্যে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বিদ্যুতের যে দাম ঠিক করা হয়েছে, তা বিদ্যুৎ বিভাগের মনঃপূত হয়নি। ফলে আরও পর্যালোচনার জন্য কোম্পানিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। ২০১০ সালে সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৯৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরে ২০১৫ সালে আরও ৯৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইউনেসকোর সিদ্ধান্ত যেভাবে পাঠ করেছিলাম, তাতে রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

রামপালের ব্যাপারে তাদের সুনির্দিষ্ট আপত্তি থাকার বিষয়টি জানানোর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো, সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই প্রকল্প নিয়ে জনগণকে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আশা করি সরকার ইউনেসকোর সিদ্ধান্ত, আমাদের আপত্তি ও দেশবাসীর বিরোধিতাকে আমলে নিয়ে প্রকল্পটি থেকে সরে আসবে।’-প্রথম আলোর সৌজন্য

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন