ল্যানসেটের প্রতিবেদন : দেশে চারজনে একজনের মৃত্যু দূষণে

  21-10-2017 07:11PM

পিএনএস ডেস্ক : বিশ্বে প্রতি ছয়টি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ী দূষণ। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ। দেশে দূষণের কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। বায়ু, পানি ও মাটির দূষণে এসব মৃত্যু ঘটছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সমন্বিত একটি গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বিশ্বে মোট ৯০ লাখ মানুষ মারা গেছে। ওই বছর এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গেছে, এই সংখ্যা তার চেয়ে তিন গুণের বেশি। এসব মৃত্যুর অধিকাংশই হয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।

বিশ্বে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি দশকের পর দশক ধরে সরকারের কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবহেলিত থেকে গেছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে রোগ ও মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দূষণ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনটি আমি দেখেছি। এতে সারা বিশ্বের দূষণের কারণ ও মৃত্যুর বিষয়টি সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে দূষণের বিভিন্ন দিক ও মৃত্যুর বিষয়টি থাকলেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়নি। তবে ল্যানসেট ওই প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও আমরা দূষণ রোধে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও যাব।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে যে ৯০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ৯২ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। শুধু ভারত আর চীনেই মারা গেছে ওই ৯০ লাখের প্রায় অর্ধেক মানুষ। উন্নত বিশ্বেও দূষণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মৃত্যু ও রোগ বাড়ছে।

দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ সবচেয়ে প্রাণঘাতী। দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী এই দূষণ। ২০১৫ সালে বায়ুদূষণে ৪২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৯০ সালের তুলনায় তা ২০ শতাংশ বেশি। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের পরেই বেশি মৃত্যু হয় পানিদূষণে। ২০১৫ সালে এই দূষণে ১৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ আর্সেনিকদূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব মানুষ যে পানি পান ও ব্যবহার করে, সেগুলোতে আর্সেনিকের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রাম মাত্রার বেশি।

অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে ৫ কোটি ৭০ লাখ মানুষ আর্সেনিকদূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। সংস্থাটির মতে, পানিতে প্রতি লিটারে ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলেই তা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ল্যানসেট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে সিসাদূষণের কারণে উচ্চরক্তচাপসহ নানা রোগে ভুগে ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে কর্মক্ষেত্রে দূষণের কারণে ওই বছর মারা যায় ৮ লাখ মানুষ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত, পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, মাদাগাস্কার ও কেনিয়ার মতো দ্রুত শিল্পায়নের দেশগুলোতে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে প্রতি চার মৃত্যুর একটির জন্য দায়ী বিভিন্ন ধরনের দূষণ। তবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো দূষণ নিয়ন্ত্রণে দিনে দিনে উদ্যোগী হচ্ছে। বিশেষ করে, পানিদূষণ রোধ, পরিচ্ছন্ন পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। চীনও পানিদূষণ রোধ এবং পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষক মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও চাঁদপুরের মতলবে বায়ুদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মাটি ও পানি পরীক্ষা করে ধারণার চেয়েও বেশি পরিমাণে দূষিত পদার্থ পেয়েছি, যা মানুষের শরীরে সংস্পর্শে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।’

ল্যানসেট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটির সহলেখক বায়ুদূষণবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পিওর আর্থের কার্তি স্যান্ডিলিয়ার মতে, দূষণ এবং এর কারণে সৃষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্বের দরিদ্র ও দুর্বলদের মধ্যে দেখা দেয়। আর এতে আক্রান্ত ভুক্তভোগীরা অধিকাংশই অনিরাপদ এবং এ নিয়ে তাদের কিছু বলারও সুযোগ থাকে না। তিনি বলেন, মৌলিক মানবাধিকার, যেমন বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাস্থ্য, সুস্থতা, নিরাপদ কাজসহ শিশুর সুরক্ষার জন্য দূষণ বড় হুমকি।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, দূষণের কারণে প্রতিবছর বৈশ্বিক সম্পদের ৪৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ক্ষতি হচ্ছে জাতীয় আয়ের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আর উচ্চ আয়ের দেশগুলোকে খোয়াতে হচ্ছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর দেশের দূষণের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন। ল্যানসেট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা সাত বছর আগে রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। সেখানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ এলাকায় দূষণের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। শীতকালে তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। রাজধানীতে দূষণের নিত্যনতুন উৎস তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাটি-পানি ও বায়ুদূষণ ছাড়াও সড়কের ডিজিটাল বিলবোর্ড, যত্রতত্র ফটোকপির দোকান থেকে তৈরি দূষিত কণা রাজধানীর পরিবেশ বিষিয়ে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে দূষণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন