চার নদীর সঙ্গে ২৬ খাল যুক্ত হলে ঢাকা বাঁচবে

  23-10-2017 04:57PM

পিএনএস ডেস্ক : সরকারের উদাসীনতা, প্রভাবশালীদের দখলে হারিয়ে গেছে ঢাকার অধিকাংশ খাল। যে কটি টিকে আছে সেগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সঙ্গে সংযোগও প্রায় কাটা পড়ছে। জলাবদ্ধ হয়ে পরিণতি ভোগ করছে ঢাকার পৌনে দুই কোটি মানুষ। ঢাকাকে বাঁচাতে খাল উদ্ধারে নামতে হবে সরকারকে।

চারপাশে নদী। মাঝখানে ভূমিতে জালের মতো বিছিয়ে থাকা আঁকাবাঁকা খাল, বিল, ঝিল। একসময় এই ছিল রাজধানী ঢাকা। বৃষ্টি হলে পানি খাল-ঝিল হয়ে বেরিয়ে গিয়ে পাশের নদীতে পড়ত। পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে যেত শহর। কিন্তু গত দুই যুগে রাজধানীর এসব খাল-জলাভূমির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। এখন সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। কিছু কিছু এলাকায় দিনের পর দিন জমে থাকছে পানি।

জেলা প্রশাসনের হিসাবে ঢাকায় খালের সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে অন্তত ২৬টি এখনো সচল করা সম্ভব বলে মনে করছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। তারা এই ২৬ খালকে ঢাকার চার নদীর সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে এর জন্য খালগুলোকে দ্রুত দখলমুক্ত করতে হবে।

সিইজিআইএস ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করতে করণীয় ঠিক করার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন

কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বিশ্বব্যাংকের জন্য ২০১৫-১৬ সালে দুটি গবেষণা করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন এই গবেষণাপ্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে ‘প্রতিবেশ প্রকৌশল’ পদ্ধতি অনুসরণের জন্য সুপারিশও করেছে। গত বছরের অক্টোবরে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) রিভিউ কমিটিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এরপর এ নিয়ে আর কোনো কথা শোনা যায়নি।

তবে ভিন্ন দাবি করেছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজধানীর খালগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের মতো কাজ করছি। কিছু খাল আমরা উদ্ধারও করেছি।’

সিইজিআইএসের গবেষণার প্রধান ছিলেন সংস্থাটির উপনির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা হোসেন। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করতে ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা ও রাজউক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এ ধরনের আংশিক ও খণ্ডিত উদ্যোগ নিয়ে রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করা যাবে না। পুরো শহরের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন আরেক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ঢাকার পূর্বাংশের জলাবদ্ধতা নিয়ে পৃথক গবেষণা করেছে রাজউকের জন্য। ২০১৫ সালে ওই গবেষণা শেষ করে প্রতিবেদন রাজউককে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ওই গবেষণাটি নিয়ে বেশ কিছু কর্মশালা ও সেমিনার করব। তারপর তা চূড়ান্ত করে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করব।’

‘প্রতিবেশ প্রকৌশল’ পদ্ধতি অনুসরণের সুপারিশ করে করা সিইজিআইএসের গবেষণায় মূলত প্রাকৃতিক প্রবাহকে সক্রিয় করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে কোন খাল কতটুকু গভীর ও প্রশস্ত রাখতে হবে, তারও একটি পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই খালগুলোকে ঢাকার চারপাশের প্রধান চার নদ-নদী—বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার সঙ্গে আবার যুক্ত করে দিতে হবে। এটা করলে এরপর খালগুলো প্রাকৃতিকভাবেই ধলেশ্বরী ও টঙ্গী খালের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যাবে।

ঢাকার চার পাশের নদী থেকে ভেতরের খালগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার আরেকটি কারণ ৯০ এর দশক তৈরি করা ৩৪ কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ। বন্যার পানি যাতে শহরে ঢুকতে না পারে সে জন্য এই বাঁধ দেওয়া হয়। খালের পানি নদীতে নেওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয় পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো বা রেগুলেটর। রেগুলেটরগুলো অকার্যকর হওয়ায় খালের পানি আর নদীতে যাওয়ার সুযোগ থাকেনি।

অবৈধ দখলের কারণে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ২৬ খালের মধ্যে শহরের পশ্চিমাংশে আছে কাটাসুর, হাজারীবাগ, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, আবদুল্লাহপুর, রামচন্দ্রপুর, বাউনিয়া, দ্বিগুণ, দিয়াবাড়ি, ধোলাই, রায়েরবাজার, বাইশটেকি ও শাহজাহানপুর খাল। পূর্বাংশে আছে জিরানী, মান্ডা, মেরাদিয়া-গজারিয়া, কসাইবাড়ি, শাহজাহানপুর, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা, খিলগাঁও-বাসাবো খাল।

এসব খালের দুই পাশে দুই থেকে তিন মিটার আয়তনের সবুজ বেষ্টনী ও হাঁটার পথ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে সিইজিআইএসের প্রতিবেদনে। আর বেশির ভাগ খাল দখলমুক্ত করে ১৫ থেকে ২০ ফুট প্রস্থে নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। তবে বাস্তব অবস্থার কারণে কয়েকটি খাল ৮ থেকে ১০ ফুটের বেশি চওড়া করা সম্ভব নয় বলেও মনে করছে সিইজিআইএস।

সিইজিআইএসের সুপারিশে ঢাকা শহরের পানিনিষ্কাশন ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য হাতিরঝিলের মতো বড় প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি বড় ভবনের মধ্যে কংক্রিটবিহীন খোলা মাটির এলাকা রাখা বাধ্যতামূলক করার জন্যও বলা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

শুথু খাল নয়, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো খনন ও দখলমুক্ত করার কাজ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে সিইজিআইএস। সেই সঙ্গে নদীগুলোর দুই পাড়ে সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই এলাকাগুলোকে নদীর জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে তৈরির জন্য বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে এই শহরকে কেউ আর রক্ষা করতে পারবে না।



কোন খাল কোন নদীতে সংযুক্ত হবে

সোয়া পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালটি কল্যাণপুর খাল হয়ে তুরাগ নদে পড়েছিল। কিন্তু খাল ও নদের সংযোগস্থলে মোহাম্মদপুর হাউজিং ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং নামে দুটি আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। তারা খালের যে অংশ দখল করেছে, তা মুক্ত করে তুরাগের সঙ্গে খালটিকে যুক্ত করতে বলেছে সিইজিআইএস।

কল্যাণপুর খালও তুরাগ নদের সঙ্গে যুক্ত। সিইজিআইএস বলছে, এই খালের ক, খ, ঙ, ঞ ও চ শাখা মিলিয়ে মোট ১৫ দশমিক এক কিলোমিটার এলাকা খনন করতে হবে। কিন্তু গাবতলী, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আদাবর, পীরেরবাগ, আগারগাঁও তালতলা, শেওড়াপাড়ার একাংশ, মাজার রোড, আনসার ক্যাম্প, লালকুঠি, টোলারবাগ, পাইকপাড়া, আহমেদাবাদ, শাহআলী বাগ, বড়বাগ ও মণিপুর এলাকায় খালটির বিভিন্ন অংশে বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

দিগুণ খাল প্রবাহিত হয়েছে মিরপুর-১, ২, ৬, ১১, ১২ নম্বর আবাসিক এলাকা, রূপনগর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা এলাকার মধ্য দিয়ে। এটিও তুরাগে গিয়ে পড়েছে। খালটির বেশির ভাগ অংশ ময়লা ফেলে ও ছাপড়াঘর তুলে দখল করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকাও ওই খালের জমিতে গড়ে উঠেছে।

মিরপুরের বাউনিয়া খালের সঙ্গে মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি খাল, বাইশটেকি খাল ও মিরপুর হাউজিং এলাকার খালগুলো সংযুক্ত। সব মিলে এটি ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা। দখলের কারণে বর্তমানে এই খালগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এগুলোকে যুক্ত করতে হবে। মিরপুরের পল্লবী, কালশী, মিরপুর ১০ নম্বর, ১৩ ও ১৪ নম্বর এবং মিরপুর ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার সব নিষ্কাশন নালা খালের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় নালার পানি খালে পড়লেও তা তুরাগে যাচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও মিরপুরের ওই এলাকাগুলোতে পানি জমে যায়।

উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকার সব নিষ্কাশন নালা যুক্ত হয়েছে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে। খালটি উত্তরার কাছে টঙ্গী খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু তা এখন বিচ্ছিন্ন। ফলে ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে উত্তরা আবাসিক এলাকায় পানি জমে যাচ্ছে। পানি সরতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগছে। তাই আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে টঙ্গী খালের সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে সিইজিআইএস।

ঢাকার একসময়কার অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি এলাকার সব নিষ্কাশন নালার পানি ধানমন্ডি লেক হয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে পড়ত। কিন্তু পান্থপথ সড়ক নির্মাণের সময় ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিল বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযোগ ছিল বালু নদীর। সেই সংযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, রাজধানীর পশ্চিমাংশের ৪৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে খালগুলো বয়ে গেছে। রাজধানীর বৃহত্তম আবাসিক এলাকা পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা এই অংশে অবস্থিত। ফলে এখানকার খালগুলোর প্রবাহ ফিরিয়ে নদীর সঙ্গে যুক্ত করলে রাজধানীর প্রায় অর্ধেক এলাকার জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। নয়তো ঢাকা শহরে জলাবদ্ধ এলাকার সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়বে।-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন