দেশে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে ডিভোর্স!

  18-11-2017 02:20PM

পিএনএস ডেস্ক: সামাজিক জটিলতার প্রভাবে দেশে বিবাহিত নর-নারীর মধ্যকার সম্পর্কের বন্ধন দিন দিন শিথিল হয়ে পড়ছে। বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা গত এক দশকে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।

এই তথ্য পাওয়া গেল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের আইন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, যৌথ পরিবারে ভাঙন, একক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর আত্মকেন্দ্রিকতা সাম্প্রতিক সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের নতুন ও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এক দশক আগেও এ ধরনের সামাজিক সমস্যা ছিল না। আগের তুলনায় প্রতারণার মাধ্যমে নর-নারীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা বেড়েছে। ফলত বিবাহবিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে বিচ্ছেদের হার ছিল দশমিক ৬। বর্তমানে এই হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক এক। বিচ্ছেদের

আবেদনকারীদের মধ্যে হাজারে ১ দশমিক ৭ জন রয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস। আর অশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৫।

গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের হার হাজারে এক দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক আটজন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে রাজশাহী বিভাগ এগিয়ে। প্রতি হাজারে সেখানে এক দশমিক নয়জনের বিচ্ছেদ হয়। রাজশাহীর পরে বিচ্ছেদ বেশি হয় খুলনায় এক দশমিক ৩। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বিচ্ছেদের পেছনে বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণে পুরুষদের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যমে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার হার বেশি। কিছু কিছু লোক হবু স্ত্রীকে জানান, তিনি ভালো চাকরি করেন তার আছে আর্থিক সচ্ছলতা। কিন্তু বিবাহিত জীবন শুরুর পর দেখা যায়, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সম্পর্কটি গড়ে তুলেছিলেন স্বামী। আবার সংখ্যায় তুলনামূলক কম হলেও কিছু নারীও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। তারা বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কাবিননামার অর্থ আদায়ের জন্য তুচ্ছ ঘটনায় বিচ্ছেদের আবেদন করেন।

আবার অনেক পুরুষ একসঙ্গে একাধিক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তা অন্য স্ত্রীর কাছে লুকিয়ে রাখছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল কর্মজীবী নারীরা বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন। কিছু ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দূরত্বও বিবাহবিচ্ছেদের জন্য দায়ী। যেমন— কাজের জন্য যে স্বামী ও স্ত্রীরা ঘর বা দেশের বাইরে থাকেন, তাদের অনেকে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দূরে থাকার কারণেও দম্পতিদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়। আর ভালো বোঝাপোড়া না থাকায় এই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকা তিক্ততা এক সময় বিচ্ছেদে রূপ নেয়। যেসব শিক্ষিত নারী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন তারা আত্মসম্মান রক্ষার খাতিরেই বিচ্ছেদে যান। তবে তুলনামূলক কম শিক্ষিত ও শুধু গৃহকর্মে জড়িত নারীরা বিচ্ছেদে কম আগ্রহী। তারা আপস করে সংসার টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আইন বিভাগের কর্মকর্তা এস এম মাসুদুল হক জানান, সামাজিক জটিলতার তীব্রতায় বিচ্ছেদের ঘটনা এক দশকে তিনগুণ বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের মঙ্গল ও হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ রোধে বিচ্ছেদে যাওয়ার মধ্যে নেতিবাচক কিছু নেই।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল জানান, নৈতিক স্খলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজে এখন বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালি, যাদের স্ত্রী তাদের থেকে দূরে থাকেন তাদের ঘিরে এই প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়। একই সঙ্গে বাড়ে সন্দেহ প্রবণতা যা পরবর্তীতে বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে। সূত্র জানায়, সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। আর উচ্চবিত্তরা সিটি করপোরেশনে না এসে পারিবারিক আদালতে গিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকজনের বিবাহের রেজিস্টার না থাকায় বিচ্ছেদের জন্য কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন না। বিচ্ছেদের জন্য সিটি করপোরেশনে আবেদনকারীদের দশ ভাগের মধ্যে মাত্র এক ভাগের বিচ্ছেদ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ঠেকানো সম্ভব।

এমনকি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে বিচ্ছেদের আবেদন জানানোর পর স্বামী ও স্ত্রীকে পরবর্তী তিন মাস যে কাউন্সিলিং দেওয়ার কথা সেখানে মোট আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র একভাগ উপস্থিত হন। বাকিরা আগে থেকেই বিচ্ছেদে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা জানান, পারিবারিক বন্ধন বিষয়ে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগতে পরিবর্তন এসেছে।

আগে ব্যক্তির চেয়ে পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। বিয়েকে মনে করা হতো জন্মান্তরের বন্ধন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এই দর্শনে এখন পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে একটি দম্পতির মধ্যে বেশকিছু বিষয়ে মতানৈক্য হলেই তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এ ছাড়া নারী এখন শিক্ষিত ও কর্মজীবী হওয়ায় একসময়ের গত্বাঁধা ধারণা, ‘নারী একা জীবন ধারণ করতে পারবে না’ তারও এখন আর ভিত্তি নেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় একজন নারী এখন তার পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা করতে পারছেন। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেক নারী নিজের পেশাজীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ফলে নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই অবস্থাটি সমাজের জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক— সে বিষয়ে মন্তব্য না করলেও নারীরা যে নিজ থেকেই এখন বিচ্ছেদে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা স্বীকার করেন এই সমাজবিজ্ঞানী।

ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে নারীরা এখন বিচ্ছেদের জন্য সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত আগে পারিবারিক সদস্যরা নিতেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি থেকে নর-নারীর মধ্যে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও বিচ্ছেদের পেছনে কাজ করছে। এ ছাড়া স্বামীর যৌতুক দাবি, তার দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, মাদকাসক্তি, দুজনের জীবনযাপনে অমিল, সংসারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা না পাওয়া এবং সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে অন্য পর নারী-পর পুরুষের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কে জড়ানো বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের তুলনায় সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়লেও জোর করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সঙ্গত নয়। স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় আছে এমন কপটভঙ্গি করার চাইতে বিচ্ছেদে যাওয়াকে তারা সমাজ ও পরিবারের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন না।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন