২০ টাকায় এক রাত!

  13-01-2018 03:10PM

পিএনএস ডেস্ক: বুধবার রাত ১১টা। রাজধানীর গুলিস্তানের মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বারান্দা। কনকনে শীতের রাতে ল্যাম্পপোস্টের স্নান আলো। ঘন কুয়াশায় মোড়া কিছু ছিন্নমূল মানুষ। চেষ্টা করছেন ঘুমানোর। সারাদিন পরিশ্রম শেষে ভাড়া দিয়েই এখানে থাকতে হয় তাদের।

সেখানে ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকার বিনিময়ে এক রাত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এ টাকায় মিলে পাটি, বালিশ আর কাঁথা। প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ কাজের সন্ধানে দূর-দূরান্ত থেকে এসে এখানে রাত কাটান। এসব ছিন্নমূল মানুষের কেউ কাগজ কুড়ায়, কেউ রিকশা চালায়, কেউ পান-সিগারেট বিক্রি করে, আবার কেউ মাদক ব্যবসায় জড়িত।

অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে দেহ ব্যবসাও করে। এদের একটা অংশ ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এখানে থাকতে থাকতে অনেকে জীবনসঙ্গীও খুঁজে পেয়েছে।

কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ জায়গায় মানুষ রাত কাটাতে আসার অন্যতম কারণ জায়গাটি নিরাপদ, লোকজন প্রায় সারারাতই চলাফেরা করে। এছাড়া বৃদ্ধ নারীরাও জায়গা ভাড়া নিয়ে সারারাত এখানে থাকেন। দিনমজুর, শ্রমিক কিংবা ছোট আয়ের মানুষরা দুই ক্যাটেগরিতে এখানে রাত কাটাতে পারেন।

এভাবেই কষ্টে রাত কাটে তাদেরভাড়া নেয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, পাটির বিনিময়ে তারা ভাড়া পান। তারা সন্ধ্যার পর এখানে আসেন। আবার সকাল ৭/৮টার দিকে চলে যান। পাটি ভাড়া দিয়ে টাকা উপার্জন তারা নিজেরাই করেন। এ জন্য কাউকে চাঁদা কিংবা ভাগ দেয়া লাগে না।

প্রায় দুই বছর ধরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশে বসবাস করছেন ফারুক। তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি রংপুর। বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি ছিল না। চার বছর আগে নদী ভাঙনে বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে যায়। তারপর ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। টাকার অভাবে বাসা ভাড়া নিতে পারেন না। তাই এখানে বিশ টাকা দিয়ে রাতে থাকতে হয়।

এছাড়া এখানে আশ্রয় নেয়া অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে দেহ ব্যবসা করে থাকে। এদের সঙ্গে যোগ দেয় ভ্রাম্যমাণ দেহ ব্যবসায়ীরাও। অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। ফলে এইডস, গণরিয়া, সিফিলিসসহ বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। এদের মাধ্যমে এ রোগ অন্যের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঝের রাস্তায় রাত কাটান ফয়সাল। তিনি বলেন, রাস্তায় কাগজ, বোতল, পলিথিন কুড়াই। এসব জিনিস দোকানে বিক্রি করি। এভাবে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়। প্রতিদিন খাওয়া বাবদ ১০০ টাকার মত খরচ হয়। ১৫ দিন পর পর বাবাকে টাকা পাঠাই। বাড়িতে বাবা-মা ও ছোট ভাই থাকে। যখন স্টেডিয়ামে বড় কোনো খেলার আয়োজন করা হয় তখন এখানে পুলিশ থাকতে দেয় না। তখন কষ্ট হয়।

কনকনে শীতের রাতও এভাবেই কাটে ছিন্নমূল মানুষদেরনাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণী জানান, তিন বছর আগে গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন পর স্বামী অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে তার খোঁজ নেই। স্বামীর খোঁজে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাড়িয়ে দেয়। এরপর বাবার বাড়ি কিছুদিন থাকেন। যেহেতু বাবা নেই, ছোট ভাই খারাপ ব্যবহার করতো। ফলে তিনি ঢাকা চলে আসেন। দিনে মানুষের বাসায় কাজ করেন। রাতে এখানে এসে ঘুমান।

সুমন নামের এক যুবক বলেন, জন্ম থেকেই ফুটপাতে আছি। বাবা-মা এখন বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। এর বাইরে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যায়, একটি মহিলা নেশা জাতীয় দ্রব্য বিক্রি করছেন।

খেটে খাওয়া মানুষ ইয়াসমিন বলেন, মেয়ে বড় অইয়্যা গেছে। রাইত হইলে চিন্তা আইস্যা পরে। মানুষ কু-প্রস্তাব দেয়। হেরা মনে করে, রাস্তায় থাকি বলে মান-ইজ্জত নাই। অনেকেই টাক-পয়সার লোভও দেখায়।

খায়রুন বিবি। বয়স পঞ্চাশ। রাজধানীর ফুটপাতেই কেটে গেছে তার জীবনের বিশ বছর। এখানে টাকার বিনিময়ে থাকতে হয়। প্রতিবার শীতে কেউ না কেউ পুরনো কাপড় দান করলেও এবার কিছু জোটেনি। ফলে একটি পাতলা ওড়নাই শীত কাটছে তার।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা- আমাগো দেহনের কেউ নাই। কত কষ্ট করতাছি কেউ খোঁজ-খবর নেয় না। আমরা মরলেই কি, বাঁচলেই কি। কি করুম- জীবনটা তো বাবা এইভাবেই গেল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। বাস্তবে ভাসমান মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ক্রমেই এ সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হয়ে মানুষ ঢাকায় আসছে।

সূত্র: ফেমাসনিউজ

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন