বেঁচে থাকুক ভালো মানুষগুলো

  21-05-2018 01:54PM

পিএনএস (মো: আল-আমীন) : সময় ছিল রাত পৌনে ১১টা, বৃহস্পতিবার। কারওয়ানবাজার হতে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়ায় নামার পথে হঠাৎ খেয়াল করলাম বাসের হেলপার একটি শিশুকে কোলে করে নামিয়ে দিচ্ছে এই বলে, সোজা চলে যা, মারে পাইয়া যাইবি। অন্যমনস্ক থেকেও বিষয়টি সহজে এড়াতে পারলাম না। এতক্ষণে বাচ্চাটা অনেকদূরে এগিয়েছে। সাথে থাকা ছোট ভাইকে দৌড় দিয়ে বাচ্চাটিকে ধরতে বললাম। আমিও পিছে পিছে দৌড় দিলাম।

বাচ্চাটাকে ধরতে পারলাম। আহা! সে কি কান্না!! আম্মুর কাছে যামু, বলে কেঁদে একাকার মেয়েটি। রাস্তার এক পাসে নিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলাম। সাথে সাথেই ৪০ থেকে ৫০ জন লোক জড়ো হয়ে গেল রাস্তার একপাশে। সবাই মায়ার চোখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ছোট্ট মেয়েটিকে। নামি কি? কই থাকো? মা-বাবা কোথায়? অল্প বয়স আর তার ওপর হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে মেয়েটিকে আরও ছোট্ট দেখাচ্ছিল। কাঁদো কাঁদো গলায় মেয়েটি নাম বললো, আজমীন। কিছু কিছু তথ্য বাচ্চাটি দিলেও বাসা ঠিক কোথায় বলতে পারছে না। শুধুমাত্র লোকেশন ছাড়া। বাসা নদীর ওপারে কালীগঞ্জ। শুধু এটুকুই বলছে বার বার। জিজ্ঞাস করলাম, আম্মা-কেঁদো না। তোমার কোনও মোবাইল নাম্বার মুখস্থ আছে।? বলল, জিরো-ওয়ান-সিক্স, ছাব্বিশ, সাতানব্বই, বারো, আঠারো (০১৬-২৬৯৭১২১৮)।

সাথে সাথে সবার কল দেওয়া শুরু হলো। দুইবার রিং হল। কিন্তু অপর-প্রান্ত থেকে কোনও উত্তর আসলো না। তৃতীয়বার কল দেওয়ার সাথে সাথে মোবাইল বন্ধ বললো। তখন পাসে থাকা সবাই একেকরকম সমাধান দিচ্ছিলো মেয়েটিকে নিয়ে। যেহেতু, আমার বাসাও নদীর ওপার তাই মেয়েটিকে সাথে করেই নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম। কিন্তু এর মধ্যে পাশে থাকা একভাই নাম- বেলায়েত হোসেন বাবু বলে উঠলেন, ভাই কিছু মনে না করলে আমি নিয়ে যাই মেয়েটিকে। পরে অন্যরা বলা শুরু করলো, আপনারা মেয়েটিকে সাথে করে না নিয়ে, পাসের থানায় নিয়ে যান।

রওনা হলাম গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিস বক্সে; সে ভাইটিকে নিয়ে। পুলিশ বক্সে যাওয়ার পর সেখানকার ডিউটি ইনচার্জ অবাইদুর রহমান আহাবকে সব ঘটনা জানালাম। তার কাছে বেলায়েত ভাই অনুরোধ করলো, মেয়েটিকে নিজের কাছে রাখার জন্য। কিন্তু অহাব সাহেব বিচক্ষণতার সাথে বললো, এই মেয়েটিকে আপনারা কেউ না নিয়ে পল্টন থানায় অধীনস্থ করতে। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জ থানার সাথে যোগাযোগ করে মেয়েটির তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

এইরকম কথা-বার্তা চলাকালীন সময়ে আমরা মেয়েটির দেওয়া নাম্বারে কল করছিলাম বারংবার। হঠাৎ কল ঢুকে গেল। আহাব সাহেব কলটি কাটতে বললেন এবং নিজে কল দিলেন সেই নম্বরে। এবার কল রিসিভ হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আপনার মেয়ের নাম কি? যথারীতি অপরপ্রান্তের উত্তর আমার মেয়ের নাম আজমীন, ওরে খুইজা পাইতাছি না।

তখন আহাব মিয়া তাকে একবারে নিশ্চিন্ত করে বললেন আপনি এখন কোথায় আছেন? আমরা আসছি। অপরপ্রান্ত থেকে গুলিস্তান গোলাপ শাহ্‌ মাজারের সামনের ঠিকানা দিল। তৎক্ষণাৎ আহাব সাহেব কনস্টেবল প্রসুন চক্রবর্তীকে আমাদের সাথে করে মেয়েটিকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসতে বললেন। তাকে আমরা মন থেকে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর রওয়ানা হলাম সেই আনন্দের ভাগীদার হতে। যখন এক মা তার মেয়েকে খুঁজে পাবেন, মেয়ে পাবে তার মাকে।

অবশেষে পৌঁছলাম সেই আনন্দঘন মুহূর্তে। দেখলাম মা যেন গোটা দুনিয়াটিকে হারিয়ে ফেলেছেন। অধির আগ্রহের অপেক্ষা তার চোখে-মুখে। হস্তান্তর করলাম মেয়েটিকে তার মায়ের কাছে, আর মনের ক্ষোভ ঝাড়লাম মেয়ের মাকে। পাসে থাকা বেলায়েত ভাই বললেন, মেয়েটাকে আমারে দিয়া দেন। আমার দুই ছেলে আছে। একটা মেয়ে হলে আর আমার কী লাগে? চার-বিঘা জমি দিয়ে দিব। মেয়েটিকে দিয়ে দাও আমাকে। মা অনায়াসে না বলে দিলেন।

পরে জানতে পারলাম মহিলাটির স্বামী ২ মাস ধরে তাদের কোন খোঁজ নেন না। মহিলা তার মেয়ে দুইটিকে নিয়ে গুলিস্তানে ভিক্ষা করে পাশের কেরানীগঞ্জ থেকে। ভিক্ষা করেই বর্তমান সংসার চালাচ্ছে মহিলাটি। অতঃপর এক ক্লান্তিময় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি নিয়ে সবাই একে অপরকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওয়ানা হলাম নিজ গন্তব্যে। এই ভালো মানুষ গুলোর জন্যই এখনো হাসি ফুটে কিছু সন্তান হারা মা-বাবার মুখে। বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক এই ভালো মানুষগুলো

(লেখক: এক্টিভিস্ট, অনলাইন লেখক ফোরাম )

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন