গ্যাস সংকট : জ্বলছে না চুলা, থাকবে পুরো রমজান

  25-05-2018 12:17PM

পিএনএস ডেস্ক : দেশজুড়ে চলমান গ্যাস–সংকটের নিরসন সহজে হচ্ছে না। আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করে সংকট নিরসনের যে আশা দেখানো হয়েছিল, পাইপলাইনের সমস্যায় তা–ও ক্রমে দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। দেশের বিদ্যমান কিংবা নতুন কোনো ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগেও অগ্রগতি নেই।

দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সার কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকেরা এমনিতেই ক্রমবর্ধমান গ্যাস–সংকটে জর্জরিত। পবিত্র রমজানে গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় সংকট আরও বেড়েছে। ঢাকা মহানগরীসহ তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির আওতাধীন এলাকাতেই চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি ৭০ কোটি ঘনফুটে (৭০০ মিলিয়ন) উঠেছে।

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, তিতাসসহ সারা দেশে এখন চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ১১০ কোটি ঘনফুট। ফলে গ্যাসভিত্তিক কোনো খাতই ঠিকমতো চলছে না। এই রমজানে গ্যাস–সংকটে সবাই বিরক্ত। তবে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এখন সহনীয়। এর পেছনে বড় অবদান অবশ্য আবহাওয়ার। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে নিয়মিত বিরতিতে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচেই আছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সূত্র জানায়, আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে এ সময় চাহিদা হতো অন্তত ১২ হাজার মেগাওয়াট। এ বছর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১০ হাজার ১৪৭ মেগাওয়াট। তবে আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠা এবং বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার সময় এখনো বাকি আছে। নতুন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রও চালু হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

ঢাকায় ওয়াসার হিসাবে চাহিদার তুলনায় পানির উৎপাদন ক্ষমতা এখন বেশি। তবে নগরীর প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে সমস্যা আছে। ওই সব এলাকায় সারা বছরই সমস্যা থাকে। এ ছাড়া যেসব এলাকায় নদীর পানি প্রক্রিয়াকরণ করে সরবরাহ করা হয়, সেখানকার পানিতে অনেক সময় দুর্গন্ধ থাকে। আর হঠাৎ কোনো পাম্প নষ্ট হলে সেই এলাকায় সমস্যা দেখা দেয়।

সব মিলিয়ে, জীবনযাপনের তিনটি মৌলিক উপাদান—গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মধ্যে গ্যাসের পরিস্থিতিই বেশ খারাপ। এই অবস্থায় দেশের শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী থেকে গ্যাস ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই বিরক্ত। এলএনজি সরবরাহ ক্রমাগতভাবে পেছাতে থাকায় এই বিরক্তি তীব্র হয়ে উঠেছে।

সরকার ২০১০ সাল থেকে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করে। শেষ পর্যন্ত গত ২৪ এপ্রিল ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) মহেশখালীতে আসে। তখনো বলা হয়েছে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সরবরাহ শুরু করা হবে। এরপর তা পেছাতে থাকে। এলএনজি আমদানির দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি খাতের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, আগামী মাসের (জুন) শেষে বা জুলাইয়ের শুরুতে জাতীয় গ্রিডে এলএনজির গ্যাস সরবরাহ শুরু করা যাবে। অর্থাৎ আরও এক থেকে দেড় মাস পরে। সুতরাং এবারের রমজান ও ঈদ গ্যাস–সংকট নিয়েই কাটাতে হবে।

এলএনজি সরবরাহে সমস্যা সম্পর্কে জানা গেছে, ভাসমান টার্মিনালের সঙ্গে সমুদ্র তলদেশের পাইপলাইনের সংযোগে ত্রুটি আছে। পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস সরবরাহ শুরুর পর এই ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। এই ত্রুটি সারাতে ১০টি স্থানে ওয়েল্ডিং করতে হবে।

এ জন্য এফএসআরইউ সরবরাহকারী এক্সিলারেট এনার্জির পরামর্শক কোম্পানি ‘দ্য ওশেন’ আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র চেয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী ৪ জুন কাজ শুরু করে দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।

স্থানীয় একটি আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই কাজের বিষয়ে আলোচনার জন্য দ্য ওশেনের কর্মকর্তারা আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসছেন। আলোচনা সফল হলে কাজ শেষ করার পর আবার থাকবে পরীক্ষামূলক সরবরাহ ও সমগ্র পাইপলাইনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন এবং গ্যাসের চাপ ও তাপের সমন্বয় করার কাজ। অর্থাৎ অন্ততপক্ষে জুনের পুরোটা সময় যাবে এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে।

তবে জুনের শেষে বা জুলাইয়ের শুরুতে এলএনজি সরবরাহ শুরু হলেই দেশে গ্যাসের সংকট মিটবে না। কারণ, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি ১১০ কোটি ঘনফুট। আর এলএনজি থেকে পাওয়ার কথা ৫০ কোটি ঘনফুট। সে ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। এলএনজি থেকে পাওয়া গ্যাস সরবরাহের জন্য যে পাইপলাইন করা হয়েছে, তা দিয়ে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস চট্টগ্রামে সরবরাহ করা যাবে। অর্থাৎ জাতীয় গ্যাস গ্রিড মাত্র ২৫ কোটি ঘনফুটের সহায়তা পাবে।

পাইপলাইনের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য নতুন একটি পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। কিন্তু কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে এই পাইপলাইন এনে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার কাজ এই বর্ষা মৌসুমে করা সম্ভব হবে না। পাইপলাইনটির নদী পারাপারের কাজ শুরু করা যাবে আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে। ওই কাজ শেষ করে আগামী বছরের শুরুতে হয়তো প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, ওই সময় বেসরকারি খাতের কোম্পানি সামিটের মাধ্যমে আরও ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এলএনজি আকারে আসতে শুরু করবে। তখন দেশে গ্যাসের চাহিদা হবে দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুট। আর সরবরাহ ক্ষমতা হবে সর্বোচ্চ ৩৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে ঘাটতি থাকবেই।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, গ্যাসের ঘাটতি পূরণের জন্য এলএনজির আমদানি বাড়িয়ে যাওয়া কোনো ভালো বিকল্প নয়। কারণ, এমনিতেই আমদানি করা এলএনজির দাম বেশি পড়বে। তার ওপর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে এলএনজি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে। বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি ব্যয় মেটানোও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। টেকসই বিকল্প হচ্ছে দেশের গ্যাস সম্পদের আহরণ বাড়ানো। কিন্তু দেশের সম্পদ আহরণ বরং কমছে। সরকারের উচিত এদিকে নজর দেওয়া।-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন