কজন মানুষের দেখা মিলেছে থাইল্যান্ডে

  12-07-2018 07:27PM

পিএনএস (মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রধান) : ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’- ভুপেন হাজারিকার এই কালজয়ী গানটির সত্যতা আরেকবার মিলেছে থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া কিশোর ফুটবলারদের উদ্ধারে নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞানকারী কজন ডুবুরির শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে। মানব-দরদি সে মানুষদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।


যে শিশুদের ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কায় থাইল্যান্ডের আকাশ একসময় কালো মেঘে ঢেকে যায়। বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয় মানবতাবাদী মানুষের মাঝে। জীবন বাজি রেখে সে অসম্ভবকে সম্ভব করে যারা কিশোর ফুটবলারদের স্বাবিক অবস্থায় ফিরে আনার দুর্লভ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা সহজাত।

জানা গেছে, ১৭ জুন সকালে প্যাকটিস করতে এসেকোচসহ তারা কোন এক অজানা কারণে নিকটবর্তী থাম লুয়াং গুহায় ঢুকে পড়ে। যে গুহায় যেতে হলে আগাম প্রস্তুতি ও আবহাওয়াগত দিকটা প্রাধান্য দেয়া ছিল অধিক যুক্তিযুক্ত। এ ক্ষেত্রে যা মানা হয়নি। ফলে ১৩টি তাজা প্রাণ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়।

নাঙ্গনন ন্যাশনাল পার্কের কাছে গুহার প্রবেশ মুখের সামনে ১১টি সাইকেল ছিল, যে সাইকেলগুলোর সূত্র ধরে এগিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা ওই গুহায় থাকতে পারে। গুহার ভেতর থেকে পাঠানো এক বার্তায় এবং ব্রিটিশ এক ডুবুরি ও স্থানীয় নৌবাহিনীর স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়।

এই থাম লুয়াং গুহা ১০ হাজার ৩১৬ মিটার লম্বা এবং থাইল্যান্ডে যত গুহা আছে, দৈর্ঘ্যের বিচারে এটি চতুর্থ। ফুটবল দলটি ওই গুহার ভেতর ঢোকার পর থেকেই প্রচুর বৃষ্টি হতে শুরু হয়। অস্বাভাবিকভাবে পানি বেড়ে যাওয়ার একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় গুহার প্রবেশপথ।

গুহার ভেতরে পানির উচ্চতা খুব দ্রুত বেড়ে গেলে কোচসহ কিশোর ফুটবলাররা ভেতরে আটকা পড়ে যান। আরো উঁচু জায়গা খুঁজতে খুঁজতে তারা চলে যান গুহার আরো গভীরে। যেখানে আলো-বাতাসের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। দেখা দেয় অক্সিজেনের চরম সংকট।

নিখোঁজ কিশোরদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর ৭ জুলাই স্থানীয় একটি সংবাদপত্রের ওয়েবসাইটে বলা হয়, উদ্ধারকারী গুহার উপরের পাহাড়ে এমন একটি সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন, যা দিয়ে বাচ্চারা যেখানে আছে সেখানে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। আশার আলো তখনই জাগে। ক্রমেই সামনে চলে আসে উদ্ধারের নানা পরিকল্পনা।

শ্বাসরুদ্ধকর এই উদ্ধার অভিযানে প্রায় ৯০ জন ডুবুরির একটি দল কাজ করে। এর মধ্যে ৫০ জনই বিভিন্ন দেশ থেকে স্বেচ্ছায় ছুটে যান। প্রথমে কিশোরদের অক্সিজেন, আলো, খাবার ও ওষুধ দেওয়া হয়। তাদের হদিস পেয়ে উদ্ধার অভিযান চালানোর সময় পানি বেড়ে যাওয়ায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়। ফলে আটকে পড়া কিশোরদের নিয়ে শুরু হয় শঙ্কা।

শুরুতে চার দিন, এরপর সপ্তাহ সবশেষে যখন বলা হলো চার মাস লাগতে পারে, তখনই বিশ্বব্যাপী সচেতন জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে বিষয়টি দারুণভাবে নাড়া দেয়। বিশ্বব্যাপী শুরু হয় প্রার্থণা। বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে যান অর্ধশত ডুবুরি। যাদের দীর্ঘ কয়েক দিনের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৮ দিন পর মুক্ত পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ পায় ১২ খুদে ফুটবলার ও তাদের কোচ।

প্রথম দিন চারজন, দ্বিতীয় দিন চারজন এবং তৃতীয় দিন বাকিদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ১১ ঘন্টার টানা অভিযানে প্রতি দুজন ডুবুরি একজন কিশোরকে উদ্ধার করেন। শেষদিনের অভিযানে অন্যদের সঙ্গে কোচকে উদ্ধার করা হয়। এই উদ্ধার অভিযানে থাই নৌবাহিনীর সাবেক এক ডুবুরি মারা যান। সামান গুনান নামে ডুবুরি গুহায় কিশোরদের অক্সিজেন ট্যাঙ্ক দিয়ে ফেরার পথে অক্সিজেনের অভাবে নিজেই প্রাণ হারান।

বিশ্বকাপ ফুটবল আসর চলাকালীন থাইল্যান্ডের ১২ ক্ষুদে ফটবলার ও তাদের কোচের করুণ পরিণতির খবর মিডিয়ায় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার পর মানবের জন্য দরদি মানুষগুলোর দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়। যাদের দৃষ্টি বলা যায় প্রায় সারাক্ষণ ছিল মিডিয়ার প্রতি। উদ্ধার অভিযান সফল হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওই মানবতাবাদীরা।

উদ্ধারের পর নিবীড় পরিচর্যার জন্য কিশোরদের রাখা হয় হাসপাতালে। বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাদের জন্য। তারা এখন হিরো। তাদের উদ্ধারকারীরা এখন বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি কাড়ছে। মূলত আসল হিরো উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া বীর ডুবুরিরা। যারা জীবন হুমকির মুখে জেনে-বুঝে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে উঠতি ফুটবলারদের নতুন জীবনদানে সফল হন। তাদের কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা কুড়ান বিবেকবান বিশ্ববাসীর।


সফলভাবে উদ্ধার অভিযানের পর এটি নিয়ে ছবি করার উদ্যোগ নেওয়ার খবর মিডিয়ায় আসছে। ভালো কথা। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া এক ডুবুরির তোলা কিছু ছবি উদ্বুদ্ধ করে ছবি তৈরিতে। আর থাই সরকার আলোচিত ওই গুহাটিকে জাদুঘরে রূপ দেওয়ার কথা ভাবছে বলে মিডিয়ায় খবর আসছে। যে যা-ই করুক না কেন, যারা এই কাজে অংশ নিয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন জীবন বাজি রাখা অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ও পুরস্কৃত করা সময়ের দাবি। তাদের ছবিগুলো সে জাদুঘরে স্থান পাওয়ার দাবি রাখে বৈকি।

ক্ষুদ্র স্বার্থে ও অতি তুচ্ছ ঘটনায় আজকের প্রেক্ষাপটে প্রায় প্রাণঘাতী মহাপাপ প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। অমানুষের পাল্লা যখন সমাজে দ্রুত বাড়ছে তখন আমরা দেখি, কিছু মানুষ সমাজে এখনো অবশিষ্ট আছে। যাদের কারণে সমাজটা আজও টিকে আছে। সে রকম মানুষদের কজনের দেখা মিলেছে থ্যাইল্যান্ডের গুহায় আটকে থাকা কিশোরদের উদ্ধারে অংশ নিতে। নিঃস্বার্থ এই মানুষগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা মমত্ত্ববোধকে হাজারো সালাম ও অশেষ শ্রদ্ধা।


লেখক : বার্তা সম্পাদক- পিএনএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন