পিএনএস (মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রধান) : শনিবার পিলখানা সদর দপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ে তিন দিনব্যাপী বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক। যদিও বিএসএফের পক্ষ থেকে হত্যাকাণ্ড বলতে অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ একতরফাভাবে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সচেতন জনগোষ্ঠীকে যারপরনাই ভাবিয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ‘হত্যাকাণ্ড’ নয়, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হচ্ছে বলে একমত হয়েছেন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) মহাপরিচালক মো. সাফিনুল ইসলাম এবং ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক (ডিজি) রজনীকান্ত মিশ্র। তবে বিএসএফের ডিজি সাম্প্রতিক সময়ে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’র সংখ্যা কিছু বেড়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘যখন কোনো বিকল্প থাকে না, প্রাণ বাঁচাতে বিএসএফ প্রতিহত করে শুধু। মানুষের জীবন তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সব কটি ঘটনাই ভারতীয় ভূমিতে ঘটেছে, আর তাতে বিএসএফ সদস্যরাও প্রাণ হারিয়েছেন।’ কয়েক মাসে আগে সাতক্ষীরা সীমান্তের কাছে বাংলাদেশি যুবকের মুখ ও পায়ুপথে পেট্রল ঢেলে বিএসএফ হত্যার চেষ্টা অভিযোগ বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
দুটি বন্ধু দেশ বাংলাদেশ-ভারত। অথচ সীমান্তে হত্যাকাণ্ডসহ যা ঘটছে, তা বন্ধুত্বের নির্দশন বহন করছে না বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটিকে অনেক আগে থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সীমান্ত হত্যা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।
আশার কথা, সীমান্ত হত্যার বিষয়ে বিজিবির মহাপরিচালক মো. সাফিনুল ইসলাম তিন দিনব্যাপী বৈঠকে সীমান্তে ‘মৃত্যু’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ উদ্বেগ জানানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ। কেননা, উদ্বেগ জানানোর মধ্য দিয়ে তিনি দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। আজকাল যা সচরাচর চোখে পড়ে না। বরং মিঁউ মিঁউ করাটাই যেন অনেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার আচরণে ফুটে উঠছে।
ভালো লাগছে এটা জেনে যে, এ বিষয়ে তদন্ত হবে। অর্থাৎ সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উভয় দেশ তদন্ত করবে। তবে তদন্তে ফলাফল কী আসবে, না আসবে; তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। তার পরও সান্ত্বনা এটা যে, বিষয়টা নিয়ে দু দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তে ঐক্যমতে পৌঁছা গেছে। এ থেকে ভালো ফল আসলেও আসতে পারে। অর্থাৎ সীমান্ত হত্যা বন্ধ হতে পারে।
বিএসএফের পক্ষ থেকে আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এবং সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় আনার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেসব কথা যে কথার কথা ছিল, সীমান্তে বাংলাদেশী অকাতরে হত্যা, সেটাই প্রমাণ করে। কাউকে গুলি করে হত্যার আগে সতর্ক করার মতো কাজটাও করা হচ্ছে না বলে চাউর আছে। কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলে তাদের আটক করা যেতেই পারে। আনা যায় বিচারের আওতায়। কিন্তু নির্বিচারে গুলি করে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের সরাসরি লঙ্গনের ঘটনা সুপ্রতিবেশী সুলভ আচরণ হতে পারে না। অথচ এ কাজটাই বন্ধু দেশটি দীর্ঘদিন যাবত একতরফাভাবে করে আসছে।
সীমান্তে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, দেখা গেছে এর বেশির ভাগই গরু আনার সঙ্গে জড়িত। সীমান্ত দিয়ে সোনা, অর্থ, মাদকদ্রব্যসহ অনেক মূল্যবাদ দ্রব্য আসা-যাওয়ার অনেক ক্ষেত্রেই নাকি ওপেন সিক্রেট। অথচ অন্যদের হত্যা তো দূরে কথা, তাদের টিকিটিও স্পর্শ করা হয় না। টার্গেট করা হয় কেবলই গরুর সঙ্গে যুক্তদের।
কারণ যা-ই হোক না কেন, দুটি বন্ধু দেশের সীমান্তে নাগরিক হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য ঘটনার অবসান হোক, এটা আইন ও মানবাধিকারে বিশ্বাসীদের একান্ত চাওয়া। কেউ অপরাধে করলে সরাসরি বুকে-পিঠে-মাথায় গুলি করে হত্যা না-করে পায়ের নিচে রাবার বুলেট ছোড়া যেতে পারে। এরপর আটক করে পতাকা বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করা অধিক যুক্তিযুক্ত। অতীতে এমন সিদ্ধান্তই হয়েছিল দুদেশের কয়েকটি সীমান্ত বৈঠকে।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে অতীতে বিএসএফ ও বিজিবি মহাপরিচালক পর্যায়ের সভায় যেসব সীদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, সেগুলো যে মানা হয়নি; ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বাস্তবতা কিন্তু সে সাক্ষ দিচ্ছে না। বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিজিবি মহাপরিচালকের মতো সচেতন বাংলাদেশীরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। যে উদ্বেগ অবসানে বিএসএফ আন্তরিকতা পরিচয় দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আমরা চাই তারা আগ্রাসী আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে সীমান্তে বাংলাদেশীদের রক্ত আর ঝরাবে না। সর্বোপরি তাদের প্রতিশ্রুতির সফল বাস্তবায়ন দেখতে চাই আমরা।
প্রতিবেদক : বিশেষ প্রতিনিধি- পিএনএস
সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল থামছে না
16-06-2019 08:49PM