মিয়ানমার ফিরতে নারাজ রোহিঙ্গারা

  20-08-2019 09:35PM

পিএনএস ডেস্ক : নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বসতভিটাসহ সম্পদ ফেরত ও নিপীড়নের বিচার নিশ্চিত না হলে মিয়ানমার ফিরতে নারাজ রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকার কর্তৃক স্বীকৃত রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের প্রতিনিধিদের কাছে সাক্ষাৎকারে এমনটি জানিয়েছেন তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গারা।

সাক্ষাৎকার শেষে হলরুম থেকে বের হওয়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের এ-ব্লকের বাসিন্দা মুহাম্মদ রিয়াজ (৩২), রশিদ আমিন (৪৫) ও আই-ব্লকের হোসেন আহমদ (৫২) এসব তথ্য জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের সেই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন শালবাগানের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি) মোহাম্মদ খালেদ হোসেন।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বেলা ১টা থেকে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে নির্মিত ক্যাম্প ইনচার্জের হলরুমে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন রোহিঙ্গারা।

সিআইসি মোহাম্মদ খালেদ হোসেন জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকে মিয়ানমারে ফেরত যাবার বিষয়ে মতামত জানানোর কথা ছিল তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে নির্ধারিত স্থানে সাক্ষাৎকার দিতে আসেননি তাদের কেউ। পরে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা তাদের সাক্ষাৎকার দিতে আসার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হয়। এরপর একেকটি পরিবার আলাদাভাবে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা অভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছেন। এসব দাবি মানা হলে তারা যেকোন সময়ই ফিরে যেতে প্রস্তুত বলে জানায়।

তিনি আরও জানান, আমরা নিয়মত মতো তাদের জানিয়েছি- মিয়ানমার ফিরে গেলে সেদেশের সরকার তাদের কি কি সুবিধা দিবে। তবে, জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না বলে ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধিরা অভয় দিলে তারা দাবিগুলো উত্থাপন করেন। এরপরও আমরা বলেছি, যারা যেতে ইচ্ছুক তারা সীমান্তে নির্মিত অস্থায়ী ঘরগুলোতে চলে আসতে পারবে।

সাক্ষাৎকারে ২১ পরিবারের নেতৃত্ব দেয়া ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. বজরুস আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রধান দাবি রোহিঙ্গা হিসেবেই তাদের নাগরিকত্ব দেয়া। এটার পাশাপাশি মিয়ানমারের মাব্রাই দীর্ঘদিন ধরে বন্দি এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকেও মুক্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া এপার হতে যারা যাবেন, তারা ওপারের কোন ক্যাম্পে নয়, সরাসরি নিজেদের পুরোনো বসতভিটায় যেতে পারে মতো ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় মিয়ানমার ফিরে গিয়ে কোন লাভ নেই বলে তালিকায় আসা রোহিঙ্গারা অভিমত জানিয়েছে।

সাক্ষাৎকার দিয়ে বের হয়ে আসা মুহাম্মদ রিয়াজ (৩২), রশিদ আমিন (৪৫) ও হোসেন আহমদ (৫২) জানান, দোদুল্যমান অবস্থায় মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই না আমরা। মিয়ানমারে আমাদের ওপর চালানো নিপীড়নের বিচার করতে হবে, সম্পত্তি ফেরতের পাশাপাশি নাগরিকত্ব দিতে হবে। এরপরই আমরা ফেরত যাব বলে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছি।

২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। পুরনো ও নতুন মিলিয়ে এখন উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার অবস্থান।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। জাতিগত নিধন ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। কিন্তু একাধিকবার সময় নির্ধারণ করেও রোহিঙ্গাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।

এদিকে, রাখাইনে সেনাবাহিনী, বিজিপি, উগ্রপন্থী রাখাইন যুবকদের নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিতে উখিয়ার শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি (আইসিআই)’র একটি টিম।

আইসিআই দলটি মঙ্গলবার বালুখালী ৯নং ক্যাম্পের ৬টি ব্লক, জি-১৮, জি- ১৯, জি-২০, জি-১, সি-১, সি-২ ব্লকের বিভিন্ন বাসস্থান ঘুরে দেখেন। একই সাথে জামতলী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেন তারা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দল বালুখালী ক্যাম্পের ক্যাম্প ইনচার্জ শেখ হাফিজুল ইসলামের কার্যালয়ে আধ ঘন্টাব্যাপী বৈঠক করেন।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফিলিপাইনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজারিও মানালো। সদস্যরা হলেন মিয়ানমারের সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান মিয়া থেইন, জাতিসংঘে জাপানের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি কেনজো ওশিমা, ইউনিসেফের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ড. অন তুন থেট, প্রফেসর ইউশিহিরো নাকানিশি এবং লিনা ঘোষ।

সোমবার বেলা ১১টার দিকে দলটি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে রয়েল টিউলিপ হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে বেলা ২টার দিকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালামের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। সেখান থেকে তারা ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে মঙ্গলবার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এরা ফিরে গেলে ‘এভিডেন্স কালেকশন এবং ভেরিফিকেশন’ নামের আরও একটি প্রতিনিধিদল ক্যাম্পে আসবেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন