দুঃসময়ের কিছু রসিকতা

  23-08-2019 03:28PM

পিএনএস (মোস্তফা মামুন) : ঈদের রেশ এখনো কাটেনি। মানুষ এখনো ঢাকায় ফিরছে। অনেকে ফিরতে পারছেও না। পথেই শেষ হচ্ছে।

একদিক থেকে ভালো হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ছিল সেটা খানিকটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে এই সপ্তাহে। একটা ভয় আরেকটা ভয়কে কমায়। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কামড়ে ডেঙ্গু কিছুটা পেছনে গেছে।

আবার সড়কে এই মৃত্যুর মিছিলটাও কর্তাব্যক্তিদের আগামী বছরের জন্য একটা ঢাল হয়ে রইল। আগামীবার যাওয়ার সময় যে দুর্ভোগ হবে তখন হয়তো তাঁরা বলবেন, রাস্তায় যানজট থাকাই ভালো। তাহলে আর দুর্ঘটনা ঘটবে না। মরবে না। সময়ের চেয়ে তো জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

আমরা তখনো কিছু বলব না। হাসব। আবার মেনেও নেব। এখন যেমন মেনে নিই। যার সঙ্গে এখন কথা হয় তিনিই ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন। দুই সিটি করপোরেশনের আনাড়িপনায় যে উঠানের আগুন চালে পৌঁছল এ বিষয়ক ক্ষোভও সবার মধ্যে। কিন্তু ক্ষোভের প্রকাশ কই। বাঙালি এমন অপূর্ব সহ্যক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে যে মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হতে চায় না। জাভেদ ভাই একদিন বলছিলেন যে এর কারণ নাকি ফেসবুক।

‘ফেসবুক?’

‘হ্যাঁ, ফেসবুক থাকাতে মানুষ সব বিষয়ের ক্ষোভ সেখানে ঝেড়ে দেয়। ফলে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশনটা হয়ে যায়। আগে সেই সুযোগটা ছিল না। ক্ষোভ প্রকাশ করলে রাস্তায় নামত। একজনের দেখাদেখি অন্যরা। এভাবেই আন্দোলন তৈরি হতো। ফেসবুক রাগ-ক্ষোভটা শোষণ করে নেওয়ায় আর রাস্তা পর্যন্ত কিছু গড়ায় না। গড়াবেও না।’

‘কিন্তু এই ফেসবুক থেকেই তো গণজাগরণ মঞ্চের মতো বড় আন্দোলন হয়ে গেল। তোমার কথাটা মানতে পারলাম না।’

‘গণজাগরণ মঞ্চ বরং আমার কথাটা আরো প্রতিষ্ঠিত করে।’

‘কিভাবে?’

‘তাতে প্রমাণিত হয়েছে ফেসবুকে যতই লেখালেখি করো, কাজ হবে না। ফেসবুকের শক্তিকে মাঠে নিয়ে আসতে হবে।’

‘কিন্তু ফেসবুকের কিছু কিছু রি-অ্যাকশনে তো কাজ হয়। ভাইরাল হওয়া অনেক ঘটনারই বিচার হয়েছে।’

‘সেটাও শাসকশ্রেণির কৌশল। ফেসবুকীয় শক্তিকে এভাবে খুশি রাখলে সুবিধা না। ফেসবুকে লিখেই জগৎ জয় হয়ে যাচ্ছে এই তৃপ্তিতে ওরা ঘরে বসে থাকবে। মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্যই ভার্চুয়াল দুনিয়ার হাতে হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

এরপর কথা বাড়ানো যেত কিন্তু ঈদের আমেজের সঙ্গে জাভেদ ভাইয়ের তির্যক দার্শনিকতা ঠিক যায় না। তার চেয়ে বরং সহজ-সরল কিছু রসিকতা করি। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

ডেঙ্গু নিয়ে অনেক আহাজারি করেছি। করে বুঝতে পেরেছি লাভ নেই। এভাবেই চলবে। মশাদের যখন মর্জি হবে কিংবা বৃষ্টি-বাদলা যখন ছাড় দেবে, তখনই গিয়ে রক্ষার প্রশ্ন। তা জীবনের অংশ যখন হয়ে গেল তখন অসুখবিসুখ নিয়ে রসিকতা চলতেই পারে।

এক রোগী ডাক্তারের কাছে গেছেন। গিয়ে বললেন, ‘আমি আগে অমুক ডাক্তারকে দেখাতাম।’

ডাক্তার মেজাজ খারাপ করে বললেন, ‘ও তো একেবারে হাতুড়ে। ওর কাছে গিয়েছিলেন কেন?’

‘হাতুড়ে বলতে...গতবার আমার ভাইয়ের জ্বর হলো। দিল নিউমোনিয়ার ওষুধ। পরে দেখা গেল আমার ভাই মারা গেছে টাইফয়েডে।’

ডাক্তার গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘তাহলে আপনি এবার ঠিক লোকের কাছেই এসেছেন। আমি যদি আপনার নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করি, তাহলে আপনি নিউমোনিয়াতেই মারা যাবেন। টাইফয়েড পর্যন্ত আর যেতে হবে না।’

একটু বেশি নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে। নিষ্ঠুর হলেও প্রাসঙ্গিক। ডেঙ্গুর এই আমলে শুরুতে রোগ ধরা পড়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। হাতুড়ে ডাক্তারের কাছেও যাওয়া চলবে না। দেরিও করা যাবে না।

এবার একজন স্মার্ট ডাক্তারের গল্প। অপারেশনের ঠিক আগে তিনি বলছেন, ‘ভয় পেয়ো না জহিরুল। একেবারে ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক থাকবে। নার্ভাস হবে না একটুও।’

রোগী ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ডাক্তার সাহেব, আমার নাম জহিরুল না।’

ডাক্তার বললেন, ‘সেটা জানি তো।’

‘তাহলে যে বলছেন...’

‘আরে জহিরুল হলো আমার নাম।’

এটা নিছকই রসিকতা। বাস্তবতা হলো আমাদের অবিবেচক প্রশাসন, অদক্ষ সিটি করপোরেশন যখন বিপদের দিকে ঠেলছে, তখন অসীম আন্তরিকতায় ডাক্তারসমাজ আমাদের টিকিয়ে রেখেছে। ডাক্তার-নার্সসহ চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত লোকজনের প্রতি আমাদের বিরাগ অনেক বেশি। তাঁদের কাজটা জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দোষটা ধরা পড়ে বড় হয়ে। সেই সময়ে আমরা ঠিক যুক্তি-বুদ্ধির মধ্যে থাকি না বলে তাঁদের কাজকে যুক্তি দিয়ে যাচাইও করা হয় না। ফলে খুব সহজেই এঁরা ভিলেন। এই ডেঙ্গু আমলে এসে দেখছি তাঁরা সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন। এত সব হতাশার মধ্যে এটাই যা একটা ভালো খবর।

ডেঙ্গু মাঝখানে অনেক বছর লুকিয়ে ছিল। পুনঃ প্রকাশ গত বছর। আর এবার যে সাঁড়াশি আক্রমণ, তাতে মনে হচ্ছে এটা বোধ হয় স্থায়ীই হয়ে গেল। যেমন স্থায়ী হয়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনা। অনেকে অবশ্য সড়কসন্ত্রাস বলছেন। তা নাম যা-ই হোক, এটা থেকে যাবে একই রকম। দূর যখন হবে না তখন এ ক্ষেত্রেও উপায়, মানিয়ে চলা। এই রসিকতাগুলো শুনে রাখুন। মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে।

ইংল্যান্ডের এক দরিদ্র মুদি দোকানদারের ডেলিভারিম্যান পর পর দুবার অ্যাক্সিডেন্ট করল। ওসব দেশের আইন তো আর আমাদের মতো নয় যে যার যা খুশি করে জায়গামতো কিছু টাকা খাইয়ে পার পেয়ে যাবে। কাজেই তাকে দুবার ক্ষতিগ্রস্তদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে সে প্রায় নিঃস্ব। দোকানটাই বিক্রি করে দিতে হবে এমন অবস্থায় ঘরে বসে সে আগামী অনিশ্চিত দিনগুলো নিয়ে ভাবছে। এই সময় হঠাৎ ছেলে দৌড়ে এসে বলল, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি এসো। ভাইয়া বাসের নিচে চাপা পড়েছে।’

দোকানির মুখে হাসি ফুটল। যাক, এবার তাহলে ভাগ্য বদলাল। বিরাট ক্ষতিপূরণ পেয়ে আগের ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।

সড়কে আমাদের অবস্থা বোধ হয় এ রকমই। দুর্ঘটনার পর পাওয়া ক্ষতিপূরণেই এখন ভরসা।

বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে একটা গাড়ি চলছে রাস্তায়। হঠাৎ আবিষ্কৃত হলো মাঝ রাস্তায় গাড়ির সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে একজন মানুষ। গাড়িটি হার্ডব্রেক করে থামল। পর্যটকরা নেমে এলেন। মানুষটি ফিসফিস করে বলল, ‘সামনে যাচ্ছে অমুক পরিবহনের বাস। ঘণ্টায় গতি ১২০ কিলোমিটার। ড্রাইভার নেশা করেছে।’

পর্যটক অবাক। মানুষটি রাস্তা শুঁকেই সব বলে দিচ্ছে।

পড়ে থাকা লোকটি মরিয়া গলায় বলল, ‘জি না। আমি ওই গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে গেছি। কিন্তু ড্রাইভার খেয়ালই করেনি। ওকে সময়মতো পৌঁছে পরের ট্রিপের জন্য যাত্রী উঠাতে হবে।’

ড্রাইভাররা তবু অধরা থেকে যায়। ধরা পড়লেও নিজের চালানো গাড়ির চেয়েও দ্রুতগতিতে বের হয়ে আসে।

কাজেই আমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। স্যার ক্লাসে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আচ্ছা যদি দেখতে পাও দুটি গাড়ি মুখোমুখি হয়ে অ্যাক্সিডেন্টের দিকে এগোচ্ছে, তখন তুমি কী করবে?’

‘স্যার, হাত নেড়ে ড্রাইভারদের সতর্ক করার চেষ্টা করব।’

‘তার পরও যদি ওরা সতর্ক না হয়...’

‘তখন দৌড়ে গিয়ে আমার ছোট বোনকে ডেকে নিয়ে আসব।’

‘কেন? ছোট বোনকে ডাকবে কেন? ডাকা তো উচিত বড় ভাইকে, সে যদি কিছু করতে পারে।’

‘না, ছোট বোনকে ডাকব কারণ, তার সড়ক দুর্ঘটনা দেখার খুব শখ।’

আমাদের সবাইকে বোধ হয় এ রকম শখ পেয়ে বসেছে। শুধু দেখেই যাই। রুখে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সবাই কর্তার তালে ঢোল বাজায়।

এই সেদিন এনডিটিভিতে অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। বিষয় কাশ্মীর।

প্রশ্ন : কাশ্মীর বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তটা তো খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। গোটা দেশের মানুষই এটাকে সমর্থন করেছে।

অমর্ত্য সেন : তা করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করে, তখন এরা ব্রিটেনে খুব জনপ্রিয় ছিল।

প্রশ্ন : তার মানে কি কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর আচরণ দখলদার বাহিনীর মতো?

উত্তর : একেবারে ঔপনিবেশিক আচরণ। মানুষকে আটকে রেখে, তার কণ্ঠ রুদ্ধ রেখে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা চলতে পারে না।

জনপ্রিয়তার জোয়ার যেদিকে, এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালে জনরোষে বিদ্ধ হবেন। দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার হুমকি। তবু অমর্ত্য সেন বলে চলেন নিজের বিবেকের বিবেচনায়।

আনন্দের বিষয়, পৃথিবীতে এখনো অমর্ত্য সেন-অরুন্ধতী রায়রা আছেন।

আফসোসের বিষয়, আমাদের এখানে এমন মানুষ এখন প্রায় বিলুপ্ত।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক কালের কণ্ঠের সৌজন্যে

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন