বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে চায় পিডিবি

  21-10-2019 08:07PM

পিএনএস ডেস্ক : আবারও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) এ প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে, ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। তখন গড়ে ইউনিট-প্রতি ৩৫ পয়সা মূল্য বাড়ানো হয়, যা ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়।
এছাড়া গত অর্থবছর রেকর্ড ৮ হাজার কোটি ১৪১ টাকা লোকসান গুনেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় এ লোকসান দিতে হয়েছে। সেই চিন্তা করেই এই প্রস্তাত দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধি হলে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানিগুলো লোকসানের মুখে পড়বে। তাই বাল্কের পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত খুচরা বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবও তৈরি করা হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন মূল্যহার কার্যকরের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব প্রসঙ্গে পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর জন্য একটি প্রাথমিক প্রস্তাব দিয়েছি। প্রস্তাবে কোনও সংখ্যার কথা উল্লেখ করিনি। শুধু লোকসানের একটা হিসাব দিয়েছি।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে জ্বালানি ব্যয় একটি বড় অংশ। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম। যদিও তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। তবে গ্যাসের ঘাটতির কারণে তরল জ্বালানিতে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন পরিচালিত হচ্ছে।

গ্যাস সরবরাহ ঘাটতির কারণে গত বছর আগস্ট থেকে সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ও সরবরাহ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর জুলাইয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে এ হার ৪১ শতাংশ। এতে ২০২০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া গত জুলাইয়ে কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি তরল জ্বালানিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৭৯ কোটি ৬২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছর এ পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮৬১ কোটি ৬৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে সাত হাজার ৫৮৭ কোটি ৪৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর পঞ্জিকার্বষ হিসাবে ২০২০ সালে এ পরিমাণ দাঁড়াবে সাত হাজার ৯২০ কোটি ৬২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ সরবরাহে আগামী বছর পিডিবির ব্যয় হবে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

এদিকে সঞ্চালন লস বাদ দিয়ে ২০২০ সালে পিডিবির বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে সাত হাজার ৬৮৩ কোটি তিন লাখ ইউনিট। এতে পিডিবির সম্ভাব্য আয় দাঁড়াবে ৩৬ হাজার ৬৪৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এতে সংস্থাটির ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় আট হাজার ৫৬০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

২০১৭ সালে বিইআরসি বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার নির্ধারণ করে চার টাকা ৮৪ পয়সা। তবে কম মূল্য গ্রহণকারী পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বেশি বিদ্যুৎ গ্রহণ করায় গড় বাল্ক বিক্রয় মূল্য হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে চার টাকা ৮০ পয়সা। আর গত অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা ৮৩ পয়সা।

২০২০ সালে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচ টাকা ৮৮ পয়সা। তবে সে সময় বাল্ক ট্যারিফ আরও কমে দাঁড়াবে চার টাকা ৭৭ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে এক টাকা ১১ পয়সা। এ ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। এজন্য বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার পরিবর্তনের অনুরোধ করেছে পিডিবি।

প্রস্তাবে আরও কিছু বিষয় তুলে ধরেছে পিডিবি। এর মধ্যে রয়েছে খুচরা মূল্যহারের ন্যায় বাল্ক ট্যারিফেও প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের ওপর ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা। যুক্তি হিসেবে এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, পিডিবিকে বিদ্যুৎ কেনায় ফিক্সড চার্জ প্রদান করতে হয়। তাছাড়া গ্যাসের মূল্যের ওপর চলতি অর্থবছর ডিমান্ড চার্জ প্রবর্তন করা হয়েছে।

এদিকে ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের একটি মধ্যমেয়াদি চিত্র তুলে ধরে মাল্টিইয়ার ট্যারিফ প্রবর্তনের প্রস্তাবও করেছে পিডিবি। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ২০২৫ সাল নাগাদ পিডিবির লোকসান বেড়ে তিনগুণ হবে। এর মধ্যে ২০২১ সালে প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াবে এক টাকা ৩০ পয়সা, ২০২২ সালে এক টাকা ৭৩ পয়সা, ২০২৩ সালে দুই টাকা আট পয়সা, ২০২৪ সালে দুই টাকা ৫২ পয়সা ও ২০২৫ সালে দুই টাকা ৪৭ পয়সা।

এতে পাঁচ বছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে যথাক্রমে ১১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ১৬ হাজার ৮৭০ কোটি, ২২ হাজার ৬৩৮ কোটি, ৩০ হাজার ৫৬১ কোটি ও ৩২ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
বাল্ক বিদ্যুৎ বৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও শিল্প গ্রাহকদের ট্যারিফ কিছুটা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাপটিভ নিরুৎসাহিত করতে বিইআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও এলএনজি আমদানি মূল পরিবর্তনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১০ শতাংশের কম বাড়লে তা সমন্বয়ের ক্ষমতা পিডিবিকে দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে।

এদিকে পিডিবির বিনিয়োগের ওপর এবারই প্রথম রিটার্ন অন রেট বেজ ধরা হয়েছে, যার পরিমাণ চার দশমিক ৫৮ শতাংশ। এছাড়া বাল্ক মূল্যহার পরিবর্তনের ফলে খুচরা পর্যায়ে বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে প্রস্তাবে।

জানতে চাইলে পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত ১২ অক্টোবর পিডিবি, বিইআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে গত অর্থবছরে বিদ্যুতে ভর্তুকি ও লোকসান বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় পিডিবিকে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠাতে বলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আগামী বছরের শুরু থেকে বর্ধিত মূল্যহার কার্যকরের সম্ভাবনার কথাও সভায় জানানো হয়। এজন্য এবার পঞ্জিকা বছরভিত্তিক প্রস্তাব করা হয়েছে।

তারা আরও জানান, বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার কতটা বাড়বে তা নিশ্চিত নয় বিধায় এবার সরাসরি তা প্রস্তাব করা হয়নি। বরং এবার প্রস্তাব কিছুটা ভিন্ন ধরনের করা হয়েছে। এতে কয়েক বছরের বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের মনোভাব যাচাই করে দেখবে বিইআরসি। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর ও আগামী অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ খাতে কতটা ভর্তুকি দিতে চায় তা বিবেচনা করে মূল্যহার সমন্বয় করবে কমিশন।

প্রসঙ্গত, গত ১২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে মোট ৫৩ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। বছরভিত্তিক ভর্তুকির হিসাব বলছে, ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ছিল ৬০০ কোটি, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এক হাজার ৭ কোটি, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে কিছুটা কমে ৯৯৪ কোটি, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে তা তিনগুণ বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৩৫৭ কোটি, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে আবার একটু কমে ৪ হাজার ৪৮৬ কোটি, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে আবার তা বেড়ে ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এরপর ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে তা ৮ হাজার ৯৭৮ কোটি, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে আবার কমে ৪ হাজার ৩৬৫ কোটিতে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে ৩ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা, এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা, গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়ায় হয় সাত হাজার ৯৭০ কোটি। চলতি অর্থবছর ভর্তুকির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা।

পিএনএস/মো. শ্যামল ইসলাম রাসেল


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন