চীন-ভারত দ্বন্দ্ব: টপ ফর্মে বাংলাদেশকে পাশে পেতে মরিয়া বেইজিং-দিল্লি

  03-07-2020 09:24PM

পিএনএস ডেস্ক : চীন-ভারত দ্বন্দ্বে সর্বোচ্চ সতর্ক বাংলাদেশ। কারো পক্ষেই অবস্থান স্পষ্ট না করে এগোচ্ছে কৌশলী পথে। নিজের স্পর্শকাতর অবস্থা বিবেচনায় দিল্লি-বেইজিং সম্পর্কে ঢাকার এ সতর্ক অবস্থান। ‘বন্ধুত্ব’ অর্জনের চেষ্টা আরও জোরদার করছে দুই দেশই। প্রতিবেশীসহ কিছু দেশকে করোনার টিকায় বশ মানানোর টার্গেট রয়েছে চীনের। সেদিকে উন্মুখ হয়ে আছে বাংলাদেশও। আবিষ্কার হলে সর্বপ্রথমেই বাংলাদেশকে তোফা হিসেবে টিকা দেওয়ার ওয়াদা করেছে চীন।

দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে কৌশলে খেলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ভ‚রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ নিষ্ক্রিয় ‘ভিকটিম’ থাকতে চায় না। বরং নিজের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এগোচ্ছে। বাংলাদেশে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে যে দুটি দেশই আসলে বাংলাদেশকে যা দেয়, তার উল্টো অনেক বেশি নিয়ে যাচ্ছে। জাপান-কোরিয়ার তুলনায় তাদের অবকাঠামো এবং ম্যানুফ্যাকচারিং প্রকল্পগুলো খুব নিম্নমানের। রোহিঙ্গা সংকটও বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে চীন ও ভারত আসলে কেবল ‘সুদিনের বন্ধু’। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো পদক্ষেপ চীন আটকে দিচ্ছে। আর ভারতও মদদ দেয় মিয়ানমারকে।

চীন-ভারত উভয় দেশই কেন বাংলাদেশকে হালে বেশি পাত্তা দিচ্ছে-এর রহস্য জানে-বোঝে ঢাকা। রফতানি পণ্যের জন্য চীন তাদের বাজার খুলে দিতে চায় বাংলাদেশকে। ভারতও দিতে চায় অনেক কিছু। বিশেষ করে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পূর্ণ নিরাপত্তা। জনমভর ক্ষমতায় রাখার গ্যারান্টি। অন্যদিকে পণ্য তৈরিতে ঠুনকো হলেও বাংলাদেশে চীন খেলছে টেকসই টার্গেটে। তারা একদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে, আবার ভারতবিরোধী বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে ভারসাম্যের দুয়ার খোলা রেখে এগোচ্ছে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষের মনোভাবের আপডেট তথ্য ভারতের জন্য উদ্বেগের। নেপালের জনগণের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ভারতবিদ্বেষ। বাংলাদেশের সরকার ভারতের আয়তআবে থাকলেও জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ বেড়েই চলছে। নানা ঘটনায় এ অঞ্চলে একের পর এক মোদির ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’ মার খাচ্ছে। এর বিপরীতে চীনের বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ বাড়ছে।

ভারত-চীনের মূল বিরোধ গালওয়া উপত্যকা নিয়ে নয়। রহস্য বা নেপথ্য ঘটনা অন্যখানে। ভারতের দুর্বলতা চিকেনস নেক বা মুরগির গলায় ধরতে চাচ্ছে চীন। বাংলাদেশ থেকে নেপাল পর্যন্ত ভারতের মাত্র ২১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সরু শিলিগুড়ি করিডোর চিকেনস নেক বা ‘মুরগির গলা’ নামে পরিচিত। এই ২১ কিলোমিটার দখলে নিতে পারলেই ভারতের সেভেন সিস্টার বা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ৭ রাজ্য ভারত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এ অঞ্চলগুলোতে স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন ধামাচাপা থাকলেও ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। বিষয়টি ভারতের জন্য উদ্বেগের। চীনের লোলুপ চোখ এই মুরগির গলার দিকে। বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতি চীন, ভুটান আর ভারতের সিকিম প্রদেশের সংযোগস্থলে একটি উপত্যকার ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করাকে কেন্দ্র করে। যাকে বলা হচ্ছে ডোকলামে রাস্তা। রাস্তাটি হলে চীনা বাহিনী চিকেনস নেকের খুব কাছাকাছি চলে আসবে।

এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই পরাশক্তি চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতি পাল্টে দিতে বসেছে। এর মাঝে চিলেচ্যাপ্টা জায়গায় বাংলাদেশ। আবার বাংলাদেশের ভ্যালু অন্যদের চেয়ে আলাদা বিবদমান দুই দেশের কাছেই। দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক এবং সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের গাঁথুনি বেশি। যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুটি দেশই সুবিধাজনক অবস্থানে। দুটি দেশেরই বিপুল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতেও ব্যাপক প্রতিযোগিতা তাদের। দুটি দেশই বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে ব্যাপক সাহায্যের প্রস্তাব দিচ্ছে।

বাংলাদেশে বড় আকারে রেল প্রকল্পে আগ্রহী দুটি দেশই। গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনেও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে উভয় দেশের। কিন্তু এসব প্রকল্প খুব বেশি এগোচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে, সেটি বেশ কিছু বাস্তব এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তার ওপর চীন বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের সামরিক খাতে বড় সরবরাহকারী। ভারত এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল, এখন তারা দ্রুত চীনকে ধরতে চাইছে।

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে কী হবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা?
লাদাখে লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোলে মুখোমুখি ভারত ও চীনের সেনাবাহিনী। উত্তেজনা কমে কমে করেও কমছে না। এ মাসের প্রথম অংশে সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। হতাহতের ঘটনা ঘটেছে চীনের পক্ষেও। তবে দেশটি এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে চীন-ভারত সীমান্তে যে উত্তেজনা চলছে, তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের গন্ধও পাচ্ছেন কেউ কেউ। যদিও প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইস্যুটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। জার্মানি দুই দেশকে উত্তেজনা এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে সরাসরি চীনের নীতির কঠিন সমালোচনা করল। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে চীনা হুমকি মোকাবিলার কথাও জানিয়েছে দেশটি।

কিন্তু প্রশ্ন কীভাবে চীনের হুমকি মোকাবিলায় ভারতকে সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র? মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও জানিয়েছেন, চীনকে নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সেনাদের অবস্থান পুনরায় পরিবর্তন করতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হিসেবে পম্পেও ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের ওপর ক্রমবর্ধমান চীনা হুমকির কথা জানান। ২৫ জুন বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে একটি সম্মেলনে প্রথমবারের মতো চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রকাশ্যে আনেন পম্পেও। এতে তিনি লাদাখে ভারতীয় সেনা হত্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি তার প্রতিবেশী দেশকে যুদ্ধের উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরেও চীন আগ্রাসন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন পম্পেও।

এখন চীনকে থামাতে ভারতের বড় ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে যদি ভারতের বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি তাতে ভারতের পক্ষে থাকে, তাহলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকেও মোড় নিতে পারে। কারণ, এ অঞ্চলে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও তখন চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দেবে। আবার পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে চীনেরও। কিন্তু প্রতিবেশী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। পম্পেও তার বক্তব্যে এসব দেশের কথাও উল্লেখ করেছেন। তাই এসব দেশে মার্কিন সেনা বৃদ্ধি হতে পারে চীনকে ঘিরে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পদক্ষেপ। তাইওয়ানের সঙ্গেও ভালো সামরিক সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেও সেনা পাঠাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ তাইওয়ানের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠেছে চীন।-ঠিকানা

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন