শিপ্রার ব্যক্তিগত ছবি যেভাবে অনলাইনে ফাঁস হলো!

  15-08-2020 06:47PM

পিএনএস ডেস্ক: কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানের পরই সিনহার কক্ষ থেকে ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক গায়েব হয়ে যায় বলে জানা গেছে।

পুলিশের গুলিতে সিনহার মৃত্যুর পর রিসোর্টে অভিযানের চালিয়ে হিমছড়ি পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথকে আসামি করে মামলার জব্দ তালিকায় দুটি ভোদকা, তিনটি ভ্যাট-৬৯ দেশি মদ, এক পুরিয়া গাঁজা ও পানির বোতলে এক লিটার দেশীয় চোলাই মদ দেখানো হয়েছে। তবে এটাকে সাজানো মামলা বলে মনে করছেন অনেকে। শিপ্রার পরিবার বলছে, ওই মামলাও একটা ষড়যন্ত্র ছিল। শিপ্রাকে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে গ্রেপ্তার দেখালেও তার সহকর্মী তাহসিম রিফাত নূরকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। পরে জামিনে কারাগার থেকে ছাড়া পান শিপ্রা।

জানা গেছে, নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালানোর সময় সিনহার কক্ষ থেকে ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক গায়েব হয়ে যায়। পুলিশের জব্দ তালিকায় তা দেখানো হয়নি।

এদিকে শিপ্রা দেবনাথের সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও ও ছবি নিয়ে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, তার ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও ফাঁস করেছে কারা?

ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে শিপ্রা দেবনাথ, তাহসিম সিফাত নূর ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে নীলিমা রিসোর্টে এক মাস ধরে অবস্থান করছিলেন সিনহা। কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের সঙ্গে তথ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত থাকা শিপ্রা দেবনাথের ‘চরিত্র হননের’ চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।

দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের স্বপ্ন ছিল বিশ্বভ্রমণ। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে তার সঙ্গে শিপ্রার পরিচয়, বন্ধুত্ব; সেখান থেকেই ‘জাস্ট গো’ নামের ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনা শুরু। এর ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে চারজনের একটি দল। সিনহা আর শিপ্রার সঙ্গে এই দলে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত আর তাহসিন রিফাত নূর। জুলাইয়ের শুরুতে তাদের এই দলটি কক্সবাজারে গিয়ে ডকুমেন্টারির জন্য কাজ শুরু করে। কিন্তু ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যু বদলে দেয় সব।

সিনহাকে গুলি করে হত্যার ঘটনার সময় তার গাড়িতে থাকা রিফাতকে গ্রেপ্তারের পর শিপ্রাকে ধরতে নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় মদ উদ্ধার দেখিয়ে মামলা করে পুলিশ। তবে রিসোর্টে ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক থাকলেও পুলিশের জব্দ তালিকায় তা দেখানো হয়নি। সেই ল্যাপটপে যেসব ছবি ও ভিডিও ছিল সেসবই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে দাবি করেছেন শিপ্রা ও তার ছোট ভাই শুভজিৎ কুমার দেবনাথ।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় আইআইএসটিতে অধ্যয়নরত শুভজিৎ বলেন, ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে তার বোনকে টার্গেট করে একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়েছে। শিপ্রার ব্যক্তিগত চরিত্রহননের চেষ্টাও চলছে। শুধু ভুয়া আইডি নয়, প্রশাসনের অনেকে নিজের আইডি থেকেও শিপ্রাকে আক্রমণ করছে। সামাজিক মিডিয়ায় কারও কারও আচরণে আমরা মর্মাহত।

এদিকে মাদকের মামলায় শিপ্রার কারামুক্তির পর সিনহার ‘জাস্ট গো’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে যে ভিডিওটি প্রকাশ হয়েছিল সেটি তিনি নিজেই ডিলিট করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন শিপ্রা।

তিনি বলেন, সিনহা ভাই নিহতের পর অনেকে নকল ডকুমেন্টরি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে ‘জাস্ট গো’ নামে প্রচার করছিল। ভাবলাম আমাদের স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাই গুগল ড্রাইভে থাকা আসল ভিডিও ইউটিউবে প্রকাশ করি সবাইকে জানাতে।

যখন দেখলাম মানুষ এটা ভালোভাবে নেয়নি, তখন ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তা ডিলিট করে দিয়েছি। অনেকে ধারণা করেছিল এটা আমার ব্যবসা ছিল, আবার অনেকে আমাকে ভুল বুঝেছিল। তাই তাদের সম্মান জানিয়ে ওই ভিডিও সরিয়ে ফেলেছি, যোগ করেন শিপ্রা।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিপ্রা বলেন, আমি সাধারণ মেয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কারও কারও আচরণে আমি অনেক হতাশ হয়েছি। আর সিনহা ভাই ও আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে, জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও তার বিচার দেখে যেতে চাই। প্রয়োজনে ন্যায় বিচারের স্বার্থে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

শিপ্রার ভাই শুভজিৎ বলেন, জাস্ট গো ডকুমেন্টারিতে সিনহার মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়েছেন শিপ্রা। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়ত অনেকেই তার হাসিমাখা মুখ ভালোভাবে নেয়নি। এমনকি একজন পুলিশ সুপারও তার আইডি থেকে শিপ্রার ব্যক্তিগত ছবি পোস্ট করেছে। এটা করার পেছনে অবশ্যই অশুভ উদ্দেশ্য রয়েছে। হঠাৎ কেন তারা শিপ্রার ব্যক্তিগত বিষয় সামনে আনবেন? সত্যকে আড়াল করে অন্য কিছু প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হিসেবেই তারা এমনটি করছেন বলে আমরা মনে করছি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিপ্রা দেবনাথের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়াকে ‘ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন করা’ বলে মনে করছেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। খোঁজ না-পাওয়া ল্যাপটপ-হার্ডডিস্ক থেকে কিভাবে এসব ফাঁস হয় তা নিয়ে প্রশ্ন রেখে রিয়াজুল বলেন, যারা সোস্যাল মিডিয়ায় এসব প্রকাশ করছে এগুলো ঠিক না। কারণ কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এসব করা আইনবিরোধী কাজ। প্রতিটা মানুষেরই তো প্রাইভেসি আছে।

যারা ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক নিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে এসব ছবি ও ভিডিও কিভাবে ফাঁস হলো পুলিশের অবশ্যই তদন্ত করে দেখা উচিত। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা আজেবাজে কথা লিখছে, তাদেরকেও খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যোগ করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান।

কেবল শিপ্রার বেলায় না যে কোনও মানুষের মর্যাদা আছে উল্লেখ করে রিয়াজুল বলেন, ব্যক্তির এই মর্যাদা ক্ষুন্ন করার অধিকার তো কাউকে দেওয়া হয়নি। যারা ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তারা অপরাধ করছে। কম্পিউটার, হার্ডডিস্কের তথ্য বাইরে গেল কিভাবে সেটা সরকারের উচিত তদন্ত করা। পুলিশ যদি সেগুলো জব্দ না করে তাহলে সেগুলো কোথায় গেল, কারা নিল, কিভাবে ছবি-ভিডিও প্রকাশ পাচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা উচিত। আমরা জানতে পারছি, এসব ছবি-ভিডিও ওই কম্পিউটারে ছিল। যদি সেখানে থাকা ছবি-ভিডিও প্রকাশ হয় তাহলে পুলিশকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কারণ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এসব ছবি-ভিডিও কম্পিউটারেই ছিল।

এভাবে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে শিপ্রা দেবনাথের মামলা করা উচিত বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। ছোট কোনও ঘটনা ঘটলেই অভিযুক্তকে এই আইনে নিয়ে আসা হয় মন্তব্য করে এলিনা বলেন, এখন তথ্য প্রযুক্তি আইন বা ডিজিটাল আইন... প্রতিকার পাওয়ার অনেক কিছু হয়েছে।

শিপ্রা দেবনাথের উচিত সরাসরি আইসিটি আইনে মামলা করা। থানা যদি মামলা না নেয়, তাহলে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। তদন্ত করে অবশ্যই দেখতে হবে এর পেছনে প্রশাসনের কেউ জড়িত কি-না। যদি জড়িত থাকে তাহলে শুধু মানহানির মামলা নয়, কেন তা প্রকাশ করেছে তাও দেখতে হবে। হঠাৎ করে ব্যক্তিগত এসব ছবি-ভিডিও কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করেছে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে, যোগ করেন মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান।

এদিকে সিনহা হত্যা মামলার আসামিদের আনুষ্ঠানিকভাবে রিমান্ড কার্যক্রম শুরু করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। পুলিশের চার সদস্যসহ সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত শুক্রবার কক্সবাজার কারাগার থেকে হেফাজতে নিয়েছে র‌্যাব। তবে মামলার তিন আসামি বহিষ্কৃত টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলালকে পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

পুলিশের গুলিতে সিনহা রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় তার বোনের করা মামলায় বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি এবং ২ নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। তারা ছাড়া আরও সাতজনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন