নারী-শিশু নির্যাতনের ১১শ মামলার বিচার স্থগিত

  20-10-2020 12:56AM

পিএনএস ডেস্ক : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনা রয়েছে। আবার উচ্চ আদালতের আদেশেই স্থগিত হয়ে আছে এ আইনে দায়ের হওয়া এক হাজার একশরও বেশি মামলার বিচারকাজ। এর মধ্যে বিচারকাজ ২১ বছর ধরে স্থগিত, ধর্ষণের অভিযোগে করা এমন মামলাও রয়েছে। এমতাবস্থায় বিচারের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকা ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন- কবে তারা বিচার পাবেন? কবে শেষ হবে তাদের অপেক্ষা?

দেশব্যাপী নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যেই সম্প্রতি নতুন এক আইনে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদ- করা হয়েছে। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো অপরাধের শাস্তি বাড়িয়ে কোনো ফল আসবে না, যদি দ্রুতগতিতে এসব মামলার বিচারকাজ শেষ না হয়। ধর্ষণ নির্যাতনের মতো গর্হিত অপরাধ দমনে অপরাধীদের দ্রুত ও দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই এমন অপরাধ হ্রাস পাবে। এসব অপরাধের অভিযোগ থেকে নির্দোষ ব্যক্তিরা যেন দ্রুত মুক্তি পান, সে জন্যও বিচারপ্রক্রিয়ায় গতি আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষকেই প্রথম উদ্যোগী হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রধান

আইন কমকর্তা এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরই বলেছি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত হয়ে থাকা মামলা নিষ্পত্তির জন্য আলাদা বেঞ্চ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনে আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে আরও একটি বেঞ্চ গঠনের আহ্বান জানাব। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সব সময়ই পুরান মামলা শুনানির জন্য আদালতে উত্থাপন করে। মামলার বাদীকেও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।


ফাতেমা বেগম নামে এক নারী তার মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে ১৯৯৭ সালে রাজধানীর সবুজবাগ থানায় একটি মামলা [নং-১০০(৫)১৯৯৭] করেন ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৬(৩) ধারায়। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পরিবর্তন করে ২০০০ সালে নতুন আইন হয়েছে। কিন্তু পুরনো আইনে করা মামলাটির বিচারকাজ আজও শেষ হয়নি। ২১ বছর ধরে মামলাটির বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে। আসামি পক্ষের এক আবেদনে ১৯৯৯ সালে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনালের বর্তমান মামলা নম্বর-১৬৩৫/২০১৮।

জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ১ জুন আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে সরাসরি অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামি পক্ষ অভিযোগ আমলে গ্রহণের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা নং- ৪১/১৯৯৯ দায়ের করলে ১৯৯৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মাদ গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি মো. লতিফুর রহমানের বেঞ্চ রুল জারি করেন। পাশাপাশি ৬ মাসের জন্য নিম্ন আদালতের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করেন। এর পর ২০০০ সালের ২৬ জুন ওই স্থগিতাদেশের মেয়াদ রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন হাইকোর্ট। পরবর্তীকালে রুলের নিষ্পত্তি না হওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটির কার্যক্রম আর এগোয়নি।

যৌতুক ও নারী নির্যাতনের আরও একটি মামলার বিচারকাজ স্থগিত হয়ে আছে ৭ বছর ধরে। রাজধানীর পশ্চিম নন্দিপাড়া খিলগাঁওয়ের রাবিয়া ইসলাম বাদী হয়ে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০০৩) এর ১১(গ) ধারায় একটি পিটিশন মামলা করেন। ২০১২ সালের ২৯ মার্চ দায়ের করা ওই পিটিশন মামলা নং-৬৫/২০১২। বর্তমানে ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন এ মামলার নম্বর ৯১০/২০১৮। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৮ সালের ৭ নভেম্বর বাদিনীর সাথে আসামি রমিজুল ইসলামের লাখ টাকা দেনমোহর ধার্যে বিবাহ হয়। বিবাহের সময় বাদিনীর পরিবার ১৫ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার দেন। বিবাহের পর থেকে আসামী বাদিনীকে যৌতুকের দাবীতে শারিরীক ও মানষিক নির্যাতন করে আসছিলেন। ২০১২ সালের ৯ মার্চ আসামীদের পশ্চিম নন্দিপাড়াস্থ বাসায় বাদিনীর কাছে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবী করে মারধর করেন। এক পর্যয়ে আসামিরা বাদিনীকে একমাত্র শিশু কন্যা সন্তান রেখে বের করে দেন। এরপরই বাদিনী ২০১২ সালের ২৯ মার্চ তৎকালীন নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৪ এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ২০১২ সালের ২৯ মার্চ বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ হয়। ঢাকা সিএমএম আদালতের তৎকালীন মহানগর হাকিম হারুন অর রশিদ তদন্ত শেষে ৩ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৪ আসামিদের বিরুদ্ধে একই বছর ১৫ এপ্রিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। মামলায় রমিজ ও তার মা গ্রেপ্তার হয়। রমিজের মা ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পান এবং রমিজ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। মামলায় একই বছর ৮ জুলাই একই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে ক্রিমিনাল আপিল নং ৫৬৪২/২০১২ দায়ের করলে ২০১৩ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ৬ মাসের জন্য নিম্ন আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত করেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট ক্রিমিনাল আপিল নং ৫৬৪২/২০১২ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করেন। এখনও ঐ স্থগিতাদেশ বহাল রয়েছে। এর ফলে মামলার বিচার আর এগোয়নি।

শুধু এ দুটি মামলার ক্ষেত্রেই নয়, যৌতুক-নির্যাতনের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আরও অনেক মামলার বিচারকাজ বছরের পর বছর ধরে স্থগিত হয়ে আছে।

সুপ্রিমকোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে বিচারাধীন ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার মামলা। এর মধ্যে প্রায় ৩৪ হাজার মামলা ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ১১শ ৫৬টি মামলা।

সম্প্রতি ধর্ষণের একাধিক বর্বরোচিত ঘটনা প্রকাশ্যে এলে বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান করে গেজেট জারি করে। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, শুধু মৃত্যুদ-ের বিধানই যথেষ্ট নয়। বিচার প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করতে হবে। কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলার বিচার শেষ করার ও তদন্ত শেষ করার নির্ধারিত যে সময়সীমা দেওয়া আছে তা প্রায় শতভাগ মামলার ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। আইনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বহুগুণ সময় বেশি লাগছে। এর ফলে বছরের পর বছর এ ধরণের মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না। এতে করে আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। শাস্তি দৃশ্যমান না হওয়ায় এ ধরণের অপরাধের মাত্রা কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে।

জানতে চাওয়া হলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ধর্ষণ, নির্যাতন, যৌতুকের বিষয়ে হাইকোর্টে যত মামলাই হোক না কেন, সব মামলায় সরকার পক্ষভূক্ত থাকে। তাই এসব ক্ষেত্রে সরকারপক্ষকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকেও লক্ষ্য রাখতে হবে কোন মামলাগুলো দীর্ঘদিন স্থগিত হয়ে থাকছে। পাশাপাশি আদালত বেশির ভাগ সময় স্থগিতাদেশ দেন একটি লিমিটেড পিরিয়ডের (নির্দিষ্ট সময়ের) জন্য। আদালতের উচিত হবে, যখনই স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর প্রশ্ন আসবে, তখনই মামলা নিষ্পত্তির আদেশ দেওয়া। তা না হলে সুবিধাভোগীপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে রাখবে। তাই এসব ক্ষেত্রে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

মনিটরিং সেল গঠনের তাগিদ

আইনজীবীরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার বিচার ত্বরান্বিত করতে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী মনিটরিং সেল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। কোন মামলার কী অবস্থা, সেটা তদারকির জন্যই এই মনিটরিং সেল থাকতে হবে। আর এই মনিটরিং সেল গঠনের জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের একটি নির্দেশনাও রয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এই সেল গঠন করতে বলা হয়।

রায়ে বলা হয়, এই মনিটরিং সেল ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার বিষয়ে বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের কমিটির কাছে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপ্রিমকোর্টের ওই কমিটি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩১ (ক) (৩) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবে।

এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, মনিটরিং সেল গঠন হলে মামলার বিচারে গতি আসত। এই যে দীর্ঘনি ধরে কোন মামলা স্থগিত থাকছে, সে বিষয়টিও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসতো। এর ফলে মানুষ ন্যায় বিচার পেত। তাই মনিটরিং সেল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।- আমাদের সময়

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন