করোনার দ্বিতীয় ঢেউ : আতঙ্ক আছে সচেতনতা নেই

  19-11-2020 11:28PM

পিএনএস ডেস্ক : দেশে তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় করোনা রোগী শনাক্তের হার বাড়ছে। টানা চতুর্থ দিনের মতো দুই হাজারের বেশি মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। আর গত ৭৮ দিনের মধ্যে গতকাল সংক্রমণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির এই চিত্র শীতে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার যে পূর্ভাবাস দেওয়া হয়েছিল, সেদিকে এগোচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক- দুই কারণে মানুষের মাঝে উদ্বেগ বেড়েছে।

এতকিছুর পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা বাড়েনি। বরং মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত রাখার যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল, তা এখন আর সেভাবে নেই। বারবার সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত পরিষ্কারের অভ্যাস এখন একেবারেই কম। শারীরিক দূরত্বের কথা ভুলতেই বসেছে মানুষ।

এদিকে করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে মাস্কসহ করোনা প্রতিরোধী সামগ্রীর দাম বেড়েছে। মাস্ক বক্সপ্রতি কোথাও কোথাও আগের বাজার দরের তুলনায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে মাস্কের দামের এই ‘হেরফের’ দেখা গেছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত একদিনে শনাক্ত ২ হাজার ৩৬৪ নতুন রোগী নিয়ে দেশে শনাক্ত মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ১৫৯ জন। এদিন মারা গেছেন ৩০ জন। বুধবার দেশে

২ হাজার ১১১ জনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবর আসে। এর আগে দেশে গত সোমবার ৭১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সেদিন করোনা শনাক্ত হয়েছিল ২ হাজার ১৩৯ জনের। এর পর গত মঙ্গলবারও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি ছিল। মঙ্গলবার ২ হাজার ২১২ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। মাঝে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজারের মধ্যে ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। কিন্তু মানুষ তা মানছে না। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেখানে স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনগণ এক হয়ে কাজ করবে। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ হচ্ছে, সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানা দরকার সেটি জানে, কিন্তু মানছে না। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তার এলাকায় মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কাজ করে তা হলে মানুষ সেটি করতে বাধ্য হবে। শুধু প্রশাসনিক আদেশ জারি ও পুলিশ দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করলেই হবে না।

অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য খাতের কাজ হবে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের সঙ্গে কারা কারা সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের খুঁজে পরীক্ষা করা। এ ছাড়া হাসপাতাল, অফিস-আদালত ও গণপরিবহনে কেউ যেন করোনায় আক্রান্ত না হয় সে বিষয়ে কাজ করা। এসব ক্ষেত্রে কীভাবে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা যায় তার প্র্যাকটিস করা। এসব কাজ করা হলে মানুষ সচেতন হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকলে মৃত্যুর হারও বাড়তে থাকবে। গত এক সপ্তাহের মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যায়, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টা মৃতের সংখ্যাও সেই ইঙ্গিত করছে।

কোনো দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিনা তা বোঝার জন্য কিছু নির্দেশক নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর একটি হলো টানা তিন সপ্তাহ ধরে মৃত্যু কমতে থাকা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেটি দেখা যায়নি। প্রথম থেকেই মৃত্যুর ওঠানামার যে ধারা ছিল তা এখনো অব্যাহত আছে।

তবে সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার শঙ্কায় মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গত কয়েক মাস মানুষের মাঝে যে ভীতি কমেছে, তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু আতঙ্ক বাড়লেও মানুষের সচেনতা বাড়েনি। বরং মাস্ক ব্যবহার কমেছে। ঢাকার রাস্তায় মাস্ক ছাড়া মানুষকে চলাফেরা করতে দেখা যায়। রাজধানীর শপিংমলসহ অফিস-আদালতে প্রবেশে জীবাণুমুক্তকরণ টানেলের ব্যবহারও কমেছে। ঢাকার বাইরে এসবের ব্যবহারের বালাই নেই।

গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ একটু বেড়েছে। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কঠোর হচ্ছে সরকার।’ এর একদিন পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করছেন। প্রয়োজনে জরিমানাও করছেন।

বাংলাদেশে করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ, তা ২৬ অক্টোবর চার লাখ পেরিয়ে যায়। এর মধ্যে গত ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ৪ নভেম্বর তা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন একদিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ২৪তম স্থানে আছে বাংলাদেশ, আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৩৩তম অবস্থানে। বিশ্বে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫ কোটি ৬৩ লাখ পেরিয়েছে; মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ১৩ লাখ।

রাজধানীর বিভিন্ন অফিস ঘুরে দেখা গেছে, সংক্রমণের শুরুতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছিল এখন আর তা নেই। গা-ঘেঁষে মানুষ কাজ করছে। পরিবহনে শারীরিক দূরত্বও তো নেই।

বেশ কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে চিকিৎসকরা বলেন, মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমেছে। খুব বাধ্য না হলে কেউ হাসপাতালে আসছেন না। অনেকে বাড়িতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এমন সময় হাসপাতালে আসছেন, যখন তার শ্বাসকষ্ট তীব্র।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, তাদের কাছে যে রোগীরা আসছেন, তার সঙ্গে কথা বলে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো আক্রান্তদের করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে অনীহা তৈরি হয়েছে। অনেকে লক্ষণ তীব্র হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন, ততক্ষণে তার ফুসফুস অনেকাংশ আক্রান্ত হয়েছে, শ্বাসকষ্ট বেড়েছে।

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, রোগীদের খামখেয়ালির কারণে অনেকে চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ দীর্ঘমেয়াদে এ রোগের বিস্তার। প্রতিনিয়ত এ রোগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের মাঝে ভীতি কমেছে। অনেকে জ্বর-ঠা-াকে মৌসুমি ফ্লু বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন