লকডাউনেও সড়কে প্রাণ গেল ৪৫২ জনের

  06-05-2021 01:14AM

পিএনএস ডেস্ক: করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ বেড়ে যাওয়ায় এপ্রিল মাসে সরকারি বিধি-নিষেধ থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনা থেমে নেই। এ মাসে ৩৯৭টি সড়ক দুঘটনায় ৪৫২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গড়ে প্রতিদিন ১৫ জন নিহত হয়েছে বলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন বলছে, এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেল। ১৪৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৫৮ জন, যা মোট নিহতের ৩৪.৯৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৭.৫৩ শতাংশ। অন্যদিকে, দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২১.২৩ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৩ জন, যা ১৬.১৫ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় সর্বোমোট আহত হয়েছেন ৫১৯ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৫৪, শিশু ৪৭।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। বুধবার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের স্বাক্ষরিত এ প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত মার্চে ৪০৯টি দুর্ঘটনায় ৫১৩ জন নিহত হয়েছিল। গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছিল ১৬.৫৪ জন। এপ্রিল মাসে প্রতিদিন নিহত হয়েছে গড়ে ১৫.০৬ জন। এই হিসেবে এপ্রিল মাসে প্রাণহানি কমেছে ৮.৯৪ শতাংশ। প্রাণহানি কমার এই হার কোনোভাবেই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না। লকডাউনের মধ্যে সারাদেশে যাত্রীবাহী বাস বন্ধ এবং মানুষের যাতায়াত যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত, তারপরেও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এই হার চরম উদ্বেগজনক।

সংগঠনটি আরও বলছে, সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ট্রাক এবং মোটরসাইকেল চরম হুমকি হয়ে উঠেছে। গত মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ৭.৪৮ শতাংশ। মোটরসাইকেল ক্রয় এবং চালনার ক্ষেত্রে নিয়মিত মনিটরিং ও ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার চিত্র আরও ভয়াবহ হবে।

যানবাহন ভিত্তিক যাত্রী/চালক নিহতের চিত্র

দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৫৮ জন তথা ৩৪.৯৫%, বাস যাত্রী ৫ জন তথা ১.১০%, ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি যাত্রী ৬০ জন তথা ১৩.২৭%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স-জীপ যাত্রী ১১ জন তথা ২.৪৩%, থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু) ৮৯ জন তথা ১৯.৬৯%, নসিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম ২২ জন তথা ৪.৮৬%, বাইসাইকেল, প্যাডেল রিকশা, পাওয়ারটিলার, ইটভাঙ্গার মেশিন গাড়ি ১১ জন তথা ২.৪৩% নিহত হয়েছে।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৫৬টি (৩৯.২৯%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৩৭টি (৩৪.৫০%) আঞ্চলিক সড়কে, ৬৬টি (১৬.৬২%) গ্রামীণ সড়কে, ৩১টি (৭.৮০%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৭টি (১.৭৬%) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দুর্ঘটনাসমূহের ৫৭টি (১৪.৩৫%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৯২টি (৪৮.৩৬%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৮টি (২৭.২০%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৩৪টি (৮.৫৬%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৬টি (১.৫১%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত/দায়ী যানবাহন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ৩১.৬৬ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৭.২৯ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স-জীপ-পাজেরো ৫ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ৩.০৭ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৮.৫৯ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-মিশুক-স্কুটার) ১৫.৯৩ শতাংশ, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ও ভ্যান ৭.৪৮ শতাংশ এবং অন্যান্য (মাটিকাটা ট্রাক্টর-রোড রোলার-পাওয়ারটিলার-ইটভাঙ্গা মেশিন গাড়ি) ০.৯৫ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক ১১৮, বাস ১৬, কাভার্ডভ্যান ১৩, পিকআপ ৩১, লরি ১১, ট্রলি ১৭, ট্রাক্টর ৮, ট্যাঙ্ক লরি ২, মাইক্রোবাস ১১, প্রাইভেটকার ৯, এ্যাম্বুলেন্স ৩, জীপ ও পজেরো ৩, পুলিশ পিকআপ ৩, মোটরসাইকেল ১৪৯, ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-মিশুক-স্কুটার ৮৩, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-টমটম- মাহিন্দ্র ২৯, বাই-সাইকেল ৬, প্যাডেল রিকশা, রিকশাভ্যান ৪, রোড রোলার ১, ইটভাঙ্গা মেশিন গাড়ি ১, পাওয়াটিলার ১ এবং মাটিকাটা ট্রাক্টর ২টি।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫.২৮%, সকালে ৩১.২৩%, দুপুরে ২১.৯১%, বিকালে ১৭.৩৮%, সন্ধ্যায় ৯.৫৭% এবং রাতে ১৪.৬০%।

দুর্ঘটনার জেলা ও বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান

ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১১২টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৩৭ জন। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। ২০টি দুর্ঘটনায় নিহত ২১ জন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ২৬টি দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত। সবচেয়ে কম পঞ্চগড় জেলায়। ২টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৮.২১%, প্রাণহানি ৩০.৩০%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.১০%, প্রাণহানি ১৭.৬৯%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯.৩৯%, প্রাণহানি ১৭.৯২%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৮২%, প্রাণহানি ৮.৮৪%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.৮১%, প্রাণহানি ৬.৬৩%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.০৩%, প্রাণহানি ৪.৬৪%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.০৪%, প্রাণহানি ৫.৭৫% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.৫৬%, প্রাণহানি ৮.১৮% ঘটেছে।

আহত ও নিহতদের পেশাগত পরিচয়

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৪ জন, সাবেক বিজিবি সদস্য ১ জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১১ জন, প্রকৌশলী ২ জন, আইনজীবী ৩ জন, পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা ১ জন, পল্লী চিকিৎসক ১ জন, স্থানীয় সাংবাদিক ৩ জন, ব্যাংক কর্মকর্তা ৩ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ৯ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২১ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৪২ জন, স্থানীয় সিএনজি চালক সমিতির সেক্রেটারী ১ জন, পরিবহন শ্রমিক ২ জন, পোশাক শ্রমিক ৪ জন, ওয়ার্কশপ শ্রমিক ১ জন, ইটভাটা শ্রমিক ৩ জন, মাটিকাটা শ্রমিক ২ জন, কৃষি শ্রমিক ৫ জন, রাজমিস্ত্রি ৬ জন, নৈশ প্রহরী ২ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধি ৩ জন, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা ২ জন, বিএনপি নেতা ১ জনসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৩ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ

প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশ গুলো হলো- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করা; চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করা; পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমানো; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা; সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করা।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন