করোনার মধ্যেই চরম ভোগান্তি নিয়ে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা

  20-07-2021 02:30AM

পিএনএস ডেস্ক: স্বজনদের সঙ্গে ঈদের দিনটি উদযাপনের আকাঙ্ক্ষা ইট-পাথরের হৃদয়হীন শহরে আটকে থাকা মানুষগুলোর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ঈদের পর টানা লকডাউনের আতঙ্ক। ফলে করোনার বাধাও এখানে তুচ্ছ।

সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এই যাত্রায় ভোগান্তি সীমাহীন। যানবাহনের চরম সংকট, অসহ্য গরম, আবার হঠাৎ বৃষ্টি এবং তীব্র যানজট। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকেই শুরু হয় যানজট। এছাড়া পথে পথে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কোথাও সামাজিক দূরত্ব নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন ছাদে কিংবা ইঞ্জিন কভারে।

আবার টার্মিনালে পড়তে হচ্ছে নানা ঝামেলায়। কোথাও কোথাও হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে দীর্ঘপথ। তবে নানা বিড়ম্বনার মধ্যেও যেন আলাদা আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন যাত্রীরা। শেকড়ের টানে আপন ঠিকানায় বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ছুটছে অবিরাম।

রাজধানীর কমলাপুরের রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট এবং মহাসড়ক ঘুরে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। তবে সরকার বলছে, যাত্রীদের দুর্ভোগ আগের চেয়ে কম। তারা যানজট ও যাত্রীদের দুর্ভোগ নিসরনে কাজ করছে।

আগামীকাল বুধবার পবিত্র ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। তবে করোনার কারণে গত বছরের মতো এবারের কুরবানির প্রেক্ষাপটও একটু ভিন্ন। টানা লকডাউনের পর গত ১৫ জুলাই থেকে লকডাউন শিথিল করে সরকার।

২৩ জুলাই থেকে সরকারের পক্ষ থেকে আবারও কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে সীমিত সময়ের মধ্যে নিজ নিজ কাজে নেমে পড়ে মানুষ। কুরবানির পশু, পোশাক ও নিত্যপণ্যের বেচাকেনাসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়।

গণপরিবহণ ছেড়ে দেওয়ায় শুরু বাড়ি ফেরার কার্যক্রম। আর ঈদের আগে ২ দিনে ছিল ব্যাপক ভিড়।

সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী: সোমবার সকাল থেকেই সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে নিয়মিত অতিরিক্ত যানবাহন ছাড়া শুরু করেছেন বাস মালিকরা। যাত্রীদের চাপ বেশি থাকলে ঈদের আগের দিন দুপুর পর্যন্ত একইভাবে অতিরিক্ত পরিবহণ চলবে। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাচ্ছেন।

গাবতলী: রাজধানীর অন্যতম এই বাসস্ট্যান্ডে গাড়ির জন্য যাত্রীদের ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ১৫শ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বাসের কাউন্টারগুলোতে ব্যাপক ভিড় ছিল। যাত্রীদের জন্য টিকিটের ছিল ব্যাপক কাড়াকাড়ি। দূরপাল্লার যাত্রার জন্য আগে যারা টিকিট নিয়েছেন তারাও নির্ধারিত সময়ে এসে গাড়ি পাননি।

সদরঘাটে: লঞ্চে ডেকে যাত্রীদের তুলনামূলকভাবে ভিড় ছিল বেশি। সেখানে সরকারি স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই তেমন গুরুত্ব ছিল না। তবে সামাজিক দূরত্ব না থাকলেও যাত্রীদের কাছ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে।

লঞ্চগুলোতে কেবিনের সংকট চরমে। লঞ্চে তিন ধরনের টিকিট থাকে। ডেক, সোফা এবং কেবিন। ডেকের জন্য আগে কোনো টিকিট কাটতে হয় না। এরা লঞ্চের ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে যায়। আর সোফার জন্য এবং কেবিনের জন্য আগে বুকিং দিতে হয়। আবার কেবিনও দুই ধরনের। নরমাল এবং ভিআইপি।

বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে জানা যায়, এক সপ্তাহ আগেই সব লঞ্চের ভিআইপি টিকিট শেষ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রভাবশালী মহল এসব টিকিট বুকিং দিয়ে রেখেছেন। কোনো তদবির ছাড়া সহজে নরমাল কেবিনও মিলছে না।

তবে সোফার টিকিট লঞ্চঘাটেও বিক্রি হচ্ছে। সোমবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর থেকেই যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে। এদিকে ঈদযাত্রায় নৌপথে যাত্রী ভোগান্তি এড়াতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ।

কমলাপুর স্টেশন: স্বাভাবিক সময়ে প্রতি ঈদে কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ১৭৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করত। এখন ৫৭টি ট্রেন চলছে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে। ফলে এখানে ভিড় কম। তবে ট্রেনের টিকিটধারী যাত্রী ছাড়াও সাধারণ লোকজন স্টেশনে আসছে।

মেইল ও কমিউটার ট্রেনের টিকিট কাটছে অনেকে, কিন্তু সীমিত টিকিট থাকায় অনেকে টিকিট কাটতে পারছে না। অনেকে বিনা টিকিটে স্টেশনে প্রবেশ করতে চাইলেও মূল প্রবেশপথে আটকে দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজিক কর্মকর্তা শওকত জামান মোহসী জানান, মঙ্গলবার অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীরা ট্রেনে করে গ্রামে ছুটবে। ২২ জুলাই ট্রেন চলবে। স্টেশনে নেই যাত্রীদের ভিড়, নেই কোনো ছোটাছুটি। অনেক লোকজন আসছে বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়তে, তাদের আটকে দেওয়া হচ্ছে।

মানুষের স্রোত: সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানায় ঈদের ছুটি ঘোষণা করা হয় দুপুর থেকে। এতে সড়কের বিভিন্ন স্থানে ঘরমুখো মানুষের জটলা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে বৃষ্টিতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ।

সোমবার দুপুরে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের ম্যাকপাই ও জিরাবো বাসস্ট্যান্ডে দেখা গেছে, কারখানাগুলো ছুটি হওয়ার পরপরই মানুষের স্রোত নামে সড়কে। কেউ কোলে বাচ্চা, আবার কেউ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন পরিবহণের জন্য। গণপরিবহণ না পেয়ে আবার রিকশায় দীর্ঘপথ পাড়ি দিচ্ছেন কেউ কেউ। আশুলিয়ার বাইপাইল ত্রিমোড়, নরশিংহপুর, নবীনগর, শ্রীপুর, আশুলিয়া বাজার এলাকায় ঘরমুখো মানুষ পরিবহণের অপেক্ষায়।

শিমুলিয়া ফেরিঘাট: সোমবার সকাল থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন যানবাহনে যাত্রীরা মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে। ঘাটের যানবাহন দীর্ঘ সারি আর লঞ্চঘাটে যাত্রীদের ভিড় রয়েছে। সকাল থেকেই মোটরসাইকেল এবং সাধারণ যাত্রী দখলে নেয় ফেরিগুলো। যাত্রী নিয়েই পারাচ্ছে ফেরি।

বিশেষ করে লঞ্চঘাটে সকাল থেকেই যাত্রীদের গাদাগাদি। লঞ্চে মানা হচ্ছে না নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি। অর্ধেক যাত্রী ধারণের কথা থাকলেও সোমবারও অধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চলাচল করছে। ঈদযাত্রায় যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে লঞ্চঘাটে উপেক্ষিত থাকছে স্বাস্থ্যবিধি সামাজিক দূরত্ব।

পাটুরিয়া: আরেকটি ফেরিঘাট পাটুরিয়া। সোমবার বেলা ১২টার পর থেকেই এখানে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। বিকালে তীব্র আকারে রূপ নেয়। ঘাট এলাকায় দীর্ঘ সময় আটকে না থাকলেও বৃষ্টির কারণে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। শিশু ও বৃদ্ধ যাত্রীদেরও বৃষ্টিতে ভিজে ফেরিতে উঠতে দেখা যায়।

সরেজমিন ঘাট এলাকায় দেখা গেছে, রাজধানী ছেড়ে আসা মানুষ দূরপাল্লার বিভিন্ন পরিবহণের বাসে পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় আসছেন। এসব বাসকে ফেরির টিকিটের জন্য আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এছাড়া লোকাল বাসে করেও পাটুরিয়া ঘাটে আসছেন যাত্রীরা। এসব যাত্রীকে বৃষ্টিতে ভিজে কিছুটা পথ হেঁটে ফেরি ও লঞ্চঘাটে আসতে হয়।

জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর জামিউল হক বলেন, রোববারের চেয়ে সোমবার যাত্রী ও যানবাহনের চাপ কিছুটা বেশি। বেলা বাড়ার সঙ্গে এটি আরও বেড়েছে। ১২টা পর্যন্ত পাটুরিয়া প্রান্তে অর্ধশত যাত্রীবাহী বাস ও শতাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি পারের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া দুই শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে নদী পারাপারের বাসের চাপ কম থাকলেও যাত্রীর চাপ রয়েছে।

মহাসড়কে যানবাহনের তীব্র সংকট: মহাসড়কে অতিরিক্ত ভাড়ায়ও মিলছে না গণপরিবহণ। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহন ও ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। গণপরিবহণ ছাড়াও মহাসড়ক দিয়ে ট্রাক, পিকআপে ঝুঁকি নিয়েও উত্তরবঙ্গের দিকে ফিরছে মানুষ।

সোমবার ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে করটিয়া হাট বাইপাস, আশেকপুর, রাবনা, এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের পূব প্রান্তসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে কয়েক হাজার যাত্রীকে গণপরিবহণের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কয়েক ঘণ্টা মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও যানবাহন না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

গণপরিবহণে চলাচলকারী কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। এছাড়া ঈদ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। মহাসড়কের রাবনা বাইপাসে সিরাজগঞ্জগামী যাত্রী ইব্রাহিম সিকদার জানান, প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যানবাহন পাচ্ছেন না।

এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে রাজশাহীগামী হামেদ আলী জানান, সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গাড়ির দেখা মিলছে না। মহাসড়ক থেকে ধুলাবালু উড়ে আসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।

তীব্র যানজট: ঘরমুখো মানুষ ও অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে সকালে ১৭ কিলোমিটার এলাকায় উত্তরবঙ্গমুখী লেনে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সোমবার ভোররাত থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।

তবে বিকাল থেকে এই মহাসড়কে ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। গণপরিবহণের চেয়ে পণ্যবাহী ট্রাক এই মহাসড়কে বেশি চলাচল করছে। মহাসড়কের রসুলপুর, পৌলি, এলেঙ্গা, আনালিয়াবাড়ী ও জোকারচর এলাকায় এমন চিত্র দেখা যায়।

কালিয়াকৈর (গাজীপুর): গাজীপুরের কালিয়াকৈর চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় সোমবার ঘরমুখো যাত্রীদের ঢল নেমেছে। সড়কে এবং বাস কাউন্টারগুলোতে রয়েছে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মানুষের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশও মানছে না অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নির্দেশনা সে উদ্দেশ্যই নষ্ট হচ্ছে।

অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে মানুষে মানুষে ভিড় তৈরি করে গাদাগাদি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার কারণে দেশব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে উপজেলার চন্দ্রাত্রিমোড় এলাকায় ঘরমুখো মানুষের তেমন ভিড় লক্ষ করা যায়নি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে। বিকালের দিকে পুরো চন্দ্রা এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। একসঙ্গে এত মানুষ বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে বের হলে যাত্রীবাহী পরিবহণের সংকট দেখা দেয়।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন