সোনার হরিণ

  26-08-2016 05:13AM

পিএনএস: অবিরাম ছুটে চলা। বিরতিহীন। কেউ পায়। কেউ পায় না। এ যেন সোনার হরিণ। এ কাহিনী কেবল আজকার নয়। বহুদিন ধরে চলে আসছে। জীবন মানে লড়াই, যুদ্ধ। কোথাও কোথাও তা আরো তীব্র। উন্নয়নের সড়কে বাংলাদেশ। বাড়ছে শিক্ষা। অর্থনৈতিক উন্নতি। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা চাকরির বাজারে। বছরের পর বছর ধরে লড়াই। হতাশ হয়ে পড়েন অনেক তরুণ। দুই হাজার পদের বিপরীতে দুই-তিন লাখ মেধাবীর লড়াই। সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিতেই দৃশ্যপট একই রকম। সবচেয়ে বিপাকে উচ্চ শিক্ষিতরা। শুধু কি চাকরির বাজার? এখনও বহু কিছুই রয়ে গেছে সোনার হরিণ। নামি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতো রীতিমতো লটারি জেতার মতো। এইতো এইচএসসি পরীক্ষা হয়ে গেলো। এখন শিক্ষার্থীরা নেমে পড়বেন ভর্তি যুদ্ধে। প্রতি পদের বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি প্রার্থী। হয়রানি ছাড়া সেবা? কোথায় পাবেন আপনি। এওতো আরেক সোনার হরিণ। সেবা খাতে হয়রানির চিত্র কিছুদিন পর পর টিআইবি’র রিপোর্টে ফুটে ওঠে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের যুব-বেকারত্ব বিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের যুবসমাজের ৯ দশমিক ১ শতাংশ বেকার। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই হারে বেকার রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ যুবক-যুবতী। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুব শ্রমশক্তি ধরে প্রতিষ্ঠানটি। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী এ বয়সী ১৯ লাখ ৩৯ হাজার তরুণ-তরুণী কোনো কাজ করেন না। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর বহু দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে যুব বেকারত্ব বেশি। ভারতে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ১০ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বেকারত্বের হার আরো বেশি। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮০ কোটি যুবক-যুবতী কোনো কাজ করেন না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিশ্ব যুব কর্মসংস্থান প্রবণতা, ২০১৫ (গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফল ইয়ুথ) শিরোনামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে বেকার বেশি। প্রাথমিক বা নিম্ন স্তরের শিক্ষা নিয়েছেন এমন তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে কম। উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতীর মধ্যে বেকারত্বের হার ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রাথমিক বা এর কম শিক্ষিতদের ৫ শতাংশের কিছু বেশি বেকার আছেন। এর আগে বৃটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। অথচ ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত তরুণের তিনজন বেকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেকারত্ব কমাতে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যাঁরা শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন, তাঁরাও আছেন। সামগ্রিকভাবে পরিসংখ্যানগুলো বলছে, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করেন। আবার অনেকে নিজের যোগ্যতার চেয়ে কম মানের কাজ করতে বাধ্য হন।

চাকরি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসই) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদেক বলেন, গত কয়েক বছরের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু সে পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে বর্তমান প্রজন্মে আগ্রহ বেড়েছে। গত কয়েকটি বিসিএসের আবেদনের সংখ্যা দেখলেই এটা দেখা যাবে। এটাই খুব ভালো লক্ষণ। বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পর সব সেক্টরে একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত দুটি বেতন স্কেলের পর সরকারি চাকরিজীবীতে বেতন ভাতা এখন যেকোনো প্রথমসারি প্রাইভেট সেক্টরের চেয়ে কম নয়। সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবী এখন প্রচুর দেশি বিদেশি প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়। তার মেধা প্রশাসনের কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছে। চাকরি ক্ষেত্রে সুনামের রাষ্ট্র তাকে পুরস্কৃত করছে। এবার থেকে সিভিল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড প্রচলন করা হয়েছে। এগুলো খুবই পজিটিভ। যা এক-দেড় যুগ আগেও ছিল না। তিনি বলেন, একটা দেশে উন্নতির লক্ষণ হচ্ছে প্রাইভেট পাবলিক একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। মাঝখানে প্রাইভেট সেক্টর একটু সমস্যার মধ্যে ছিল। এখন দুটিই সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, বাংলাদেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে উচ্চ শিক্ষার কোনো সমন্বয় নেই। কোন সেক্টরে কত লোক প্রয়োজন তার পরিসংখ্যান তো দূরের থাক কোনো ধারণা পর্যন্ত নেই। অর্থনৈতিক গতির সঙ্গে শিক্ষার কোনো সমন্বয় না থাকায় শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ।

উচ্চ শিক্ষায় এখন কড়া নাড়ছে ভর্তি পরীক্ষা। গত ১৮ই আগস্ট ঘোষিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ছিল ৭২. ৪৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪৮,৯৫০ শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের জন্য এখন অপেক্ষা করছে আরো বড় চ্যালেঞ্জ। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবেন খুবই অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী। বুয়েট, মেডিকেল কলেজ এবং পাবিলক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইবেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের চেষ্টা থাকবে প্রকৌশল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে। আর মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরে থাকবে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তিচ্ছুরা অবশ্য খুব ছোট একটা সুখবর পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বাড়ছে ২০০। তবে এতে পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না। গল্পটি পুরনোই থাকবে। প্রতি আসনের বিপরীতে পরীক্ষা দিবেন ৩০/৪০ বা তারও বেশি গুণ শিক্ষার্থী। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরো বেশি হবে। দেখা যাক, এই ভর্তি যুদ্ধে কারা জয়ী হয়।

সেবা পেতে হয়রানি- বহুদিন ধরেই এটি পরিণত হয়েছে কালচারে। গত জুন মাসের শেষ দিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশিত এক জরিপ রিপোর্টে ফুটে ওঠে সেবা পেতে মানুষ কী পরিমাণ দুর্নীতির শিকার হন তার চিত্র। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৭.৮ ভাগ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৫৮.১ ভাগ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। ২০১৫ সালে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির হার ২০১২ তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত। রিপোর্টে বলা হয়, সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় পাসপোর্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে। এর হার ৭৭.৭ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থায় দুর্নীতির শিকার হন ৭৪.৬ শতাংশ, শিক্ষায় ৬০.৮ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশের ১৫ হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত সপ্তমবারের মতো খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপে অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৭১ ভাগ খানা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটিকে চিহ্নিত করেছেন। ১৫টি খাতকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাত সমূহের মধ্যে ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইনশৃখলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ সেবা, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, গ্যাস, বিআরটিএ, বীমা। এইতো গেল টিআইবির হিসাব। বেশ কয়েকটি সেবা প্রতিষ্ঠানে সরজমিন পরিদর্শনেও পাওয়া গেছে একই চিত্র। হয়রানি ছাড়া সেবা পাওয়ার সুযোগ একেবারেই কম। ভোগান্তি পোহাতে হবে পদে পদে। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানেও একই চিত্র। নামিদামি অনেক হাসপাতালে নানা রকম যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় রোগীদের। আইসিইউ বাণিজ্য কথাটিতো এখন ভালো ভাবেই চালু হয়েছে। শোনা যায় না, সিজার ছাড়া সন্তান জন্মদানের কথাও। এমনকি বহু নামিদামি চিকিৎসকের সিরিয়াল পাওয়াও সোনার হরিণ।


পিএনএস/ বাকিবিল্লাহ্



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন